বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। রাঙামাটি শহরে একমাত্র বেসরকারী হাসপাতাল এলায়েন্স কেয়ার হেল্থ সেন্টার। শহরের উত্তর কালিন্দীপুর বিজন সরনী এলাকায় হাসপাতালটির অবস্থান। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এ হাসপাতালটি এখনো অনেকের কাছে অজানা। ২৪ ঘন্টা সেবা দেওয়া হয় হাসপাতালটিতে। রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সম্পন্ন দুটি অপারেশন কক্ষ। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগী দেখেন।
হাসপাতালটিতে রয়েছে সিজারিয়ান অপারেশন, নরমাল ডেলিভারী, ডিইএন্ডসি,জরায়ু টিউমার অপারেশন, লোপারোটমি,হিসটেরেক্টটমি, এপেন্ডিসেক্টটমি, টনসিলেক্টটমি, থাইরয়েড অপারেশন,পিত্তথলি পাথর অপারেশন, কিডনি পাথর অপারেশন, মুত্রথলিতে পাথর অপারেশন,খতনা বা সারকামসিশন সেবা।
হাসপাতালটিতে রয়েছে ২ টি ভিআইপি (খুব গুরুত্বপুর্ন ব্যাক্তি) সহ ৬টি কেবিন। শিশু রোগীদের জন্য রয়েছে ৩টি বিশেষ বেড, মহিলা রোগীদের জন্য ৫টি বেড, পুরুষ রোগীদের জন্য ৬টি সহ মোট ২০টি বেড।
হাসপাতালটির অন্যতম প্রতিষ্ঠা পরিচালক ডা.ক্যায়েং চাক্ (কেটি) বলেন, দীর্ঘ যুগ ধরে অভিযোগ ছিল, পাহাড়ের স্বাস্থ্য সেবার মান ভাল নয়। রোগীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমার এ আইডিয়া এসেছে। কয়েকজন সমমনা বন্ধু নিয়ে এটি করেছি। হাসপাতালটি যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালে ১ এপ্রিল। আমাদের উদ্দেশ্যে রোগীদের উন্নত সেবা দেওয়া এবং সেটা করে যাচ্ছি।
এখানে অনেক রোগী আছে, যারা সাধারণ হাসপাতালে থাকতে পছন্দ করেন না। শত শত রোগী ভিড়ে গাদাগাদি করে থাকা তাদের পছন্দ নয়। আশপাশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চায়। অনেকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ দরকার। অনেকে আছে বৃদ্ধ বয়সে এসে স্ত্রী সন্তানকে কাছে পায় না। কিন্তু তাদের সার্বক্ষনিক মেডিকেল সেবা দরকার। তাদের অর্থ থাকলেও সে সেবা হয়ত সাধারণ হাসপাতালে পাওয়া সম্ভব হয় না। তারা আমাদের মত হাসপাতালের প্রয়োজনীতা অনুভব করেন।
এছাড়া অনেক সময় অসময়ে হাসপাতালে রোগী আনা হয়। তার জরুরী চিকিৎসা দরকার। সেটি হয়ত ছোট কিংবা বড় অপারেশন হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে হয়ত হাসপাতালে সে সেবা তারা পায় না। একটি অপারেশনের জন্য একটি টিম দরকার। এ টিমের একজন না থাকলে সে অপারেশন করা সম্ভব হয় না। বাস্তবতার কারণে এ চিত্র দেখা যায় হাসপাতালগুলোতে। ফলে রোগীকে চিকিৎসা সেবার জন্য অন্য হাসপাতালে দৌড়াতে হয়। এ শূণ্যতা আমরা পুরণ করতে এ হাসপাতাল করেছি। এখানে ২৪ ঘন্টা সেবা দিচ্ছি আমরা। অপারেশনের জন্য আমাদের টিমটি সব সময় প্রস্তুত থাকে। অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্স আমাদের আছে। আমাদের অপারেশন কক্ষগুলো ও যন্ত্রপাতিগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির।
কেটি বলেন, কোন রোগী যদি আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ভাল হয়ে ঘরে ফিরে এতে আমাদের মত খুশি কেউ হয় না। অনেক সুখের ঘটনা আছে আমাদের। মৃত্যুর পথযাত্রী রোগী আমাদের এখানে এসে জীবন ফিরে পেয়েছে। আমরা জানতাম পনের বিশ মিনিট দেরী হলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না। এমন অবস্থায় আমরা দ্রুত সেবা দিয়ে সুস্থ করেছি।
এসবের মাঝে কিছু কষ্টের ঘটনাও আছে। কোন রোগী যদি মৃত্যু বরণ করে সবচেয়ে আমাদের খারাপ লাগে। অনেকে মনে করে আমাদের হাসপাতালে কোন রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। বিপরীতে শত শত সুখের ঘটনা আমাদের আছে। এগুলো প্রচার পায় না। আমরা মনে সুখ অনুভব করি। মৃত্যুর পথ থেকে জীবন ফিরে পাওয়া রোগীরা আমাদের খোঁজ খবর নেন।
কেটি বলেন, অনেকে এলান্সের সেবা খাতে বেশী খরচের কথা বলতে পারে। কিন্তু বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। এখানে সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করবে রোগীরা। রোগীকে যে ২৪ ঘন্টা সেবা দিতে হয় তার জন্য প্রয়োজন হয় অর্থ। আমরা ঔষধপত্র সহ হিসাব ধরি। অন্য হাসপাতালে প্রতিদিন ঔষধপত্র কিনতে হয়। ঔষধের জন্য দৌড়াতে হয়। আমরা শেষে সেবার খরচ নিই। এতে টাকার সংখ্যাটি হয়ত বড় দেখা যায়। বাস্তবিক অর্থে এ খরচ বেশী নয়।
পরিস্কার পরিচন্ন আর নিরিবিলি পরিবেশের জন্য রাঙামাটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরাও আমাদের হাসপাতালে এসে চিকিৎসা সেবা নেন।
এলায়েন্স হাসপাতালটিতে ২ টি ভিআইপি (খুব গুরুত্বপুর্ন ব্যাক্তি) সহ ৬টি কেবিন। শিশু রোগীদের জন্য রয়েছে ৩টি বিশেষ বেড, মহিলা রোগীদের জন্য ৪টি বেড, পুরুষ রোগীদের জন্য ৭টি সহ মোট ২০টি বেড।
হাসপাতালটির একজন নার্স অন্তরা চাকমা (৩০)। বলেন, আমরা এখানে ৭ জন নার্সসহ ২২ জন স্টাফ নিয়োজিত। সব সময় একজন ডাক্তার থাকে। রোগী সেবায় নার্সরা পালাক্রমে ডিউটি করি। কোন জরুরী অপারেশন রোগী হাসপাতালে আসলেই আমরা ১০/১২ মিনিটের মধ্যে অপারেশন কক্ষ প্রস্তুত করি। ডাক্তার এসেই অপারেশন কাজ শুরু করতে পারেন।
অন্তরা বলেন, রাঙামাটি শহরে এ হাসপাতালটি হয়েছে বলে আমাদের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর আগে আমি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে চাকুরী করেছি। সেখানে বেতন ভাল ছিল। কিন্তু পরিবার সবাই রাঙামাটিতে থাকার কারণে এ টাকা যথেষ্ট নয়। রাঙামাটিতে বেতন কম হলেও চলছে।
রাঙামাটি সিভিল সার্জন ডা. শহীদ তালুকদার বলেন, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল তারা প্রাইভেটে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে। এটা একটা ভাল দিক। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা ভাল নয়। তারা বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা পেতে চায়। তাদের সেবা প্রাপ্তির জন্য আমরা হাসপাতালের বেড বাড়ানোর কাজ করছি। আমরা প্রাইভেট হাসপাতাল বাড়ানোর পক্ষে বলি না। সর্বোত্তম সেবা দেওয়া আর রোগীর কম খরচে চিকিৎসা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার উপর প্রাধান্য দিই।
রাঙামাটির বিশিষ্ট ব্যাক্তি মনিরুজ্জামান মহসিন রানা বলেন, সারা বাংলাদেশের সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার কথা আমরা সবাই জানি। সরকারী হাসপাতালগুলোর এ শূণ্যতা পুরণ করতে বেসরকারী হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এটা ঠিক এসব হাসপাতাল সাধারণত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়। রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ করা হয়েছে কিন্তু সেটি এখনো আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। ফলে আমরা প্রাইভেট হাসপাতাল খুঁজি। এগুলোতে যদি ভাল ডাক্তার থাকেন আর চিকিৎসা সেবার যে ফিস নেওয়া হয় তা যদি সহনীয় পর্যায়ে হয় তাহলে রোগীদের জন্য ভাল হয়।
এলায়েন্সের পরিচালক ডা.ক্যায়েং চাক্ বলেন, অনেক রোগী আছে যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় কিন্তু চিকিৎসা প্রয়োজন। তাদেরকেও আমরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতাল শুরুর পর থেকে এমনও কোন রোগীকে নামমাত্র অর্থ নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে বাড়িতে পাঠিয়ে সেটা হয়তো অর্থ দ্বারা বিবেচনা করা যাবে না। আমাদের লক্ষ্য যেন কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।