রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা: অনিক চাকমা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ৩ লংগদুর শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার বান্দরবানে দূর্গা পূজা উদযাপন কমিটির সাথে সেনাবাহিনীর মতবিনিময় ১৬ বছর পর লংগদুতে জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত পরিকল্পিত সংঘাত সৃষ্টিকারী পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার দাবি পিসিসিপি'র
সিএইচটি টুডে ডট কম ডেস্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামের পুনর্গঠিত ভূমি কমিশন ও এর চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে নিজ ফেইসবুক আইডিতে চাকমা সার্কেল ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় নিজস্ব মতাসত ব্যক্ত করেছেন সেটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
সূচী
সূচনা; কমিশন আইনের ২০১৬ এর সংশোধনী; সংশোধনীর প্রেক্ষাপট; মূল আইন ও সংশোধিত আইনের পার্থক্য; পুনর্গঠিত কমিশনের বৈঠক; জুন ২০১৭ থেকে জুন ২০১৮ এর মধ্যেকার সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী; ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের ব্যাপ্তি ও প্রকারভেদ; বিরোধ নিষ্পত্তিতে কমিশনের মুল চ্যালেঞ্জসমূহ; বিরোধের পক্ষগণের ভূমিকা ও বিচার পদ্ধতি; উপসংহার
১। সূচনা
ফিলিপাইনের জাতীয় আদিবাসী কমিশন (National Commission on Indigenous Peoples) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন-কে আদিবাসীদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভূমিদাবী নিরসনের ক্ষেত্রে “সর্বোত্তম রেওয়াজ এবং দৃষ্টান্ত” (Best Practices and Examples) হিসেবে বিবেচনা করে আমি জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে ২০১৪ সনে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করি (Roy, 2014; রায়, ২০১৭, তৃতীয় অংশ) । এতে কমিশন সংক্রান্ত তৎকালীন আইনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল:
“২০০১ সালের [ভূমি কমিশন] আইন ১৯৯৭ সালের [পার্বত্য চট্টগ্রাম] চুক্তির অভিপ্রায়কে (spirit) অনুসরণ করেছিল, কিন্তু এর শর্তগুলো নয়। তবে এর কাঠামো এবং এখতিয়ারভুক্ত কার্যক্ষেত্র চুক্তি এবং জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ২৫-৩০ এর সাথে” (রায়, ২০১৭: ১১০, ১১১) ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (অতঃপর “ভূমি কমিশন”)-এর উপরোক্ত বিবরণীতে ২০০২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আইনটির সংস্কারের বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের দীর্ঘ এক দশকের দাবিনামা পেশ ও দেন-দরবারের প্রয়াস এবং সরকারের স্থবিরতার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলা হয়েছিল যে: “বিভিন্ন মহলে এই বিশ্বাস রয়েছে যে সরকারের ‘নিরাপত্তা’ সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিরোধিতার কারনে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য থেকেও প্রস্তাবিত আইনী সংশোধনীটি deep fridge -এর গভীরে চলে [গেছে]” (রায়, ২০১৬: ৭৩)।
এই প্রক্রিয়ার চড়াই-উৎরায়ের কাহিনী আঞ্চলিক পরিষদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত জনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিতে আরও অনেক গভীরে যাওয়া যাবে। তাই এ বিষয়ে তেমন আর বেশী কিছু না বলে আমি পরিষদের অতি কাছের ব্যক্তিদের লেখা পড়ার আহবান জানাচ্ছি (যথাঃ চাকমা, ২০১২ ও Chakma, 2013) ।
জুলাই ২০০১-এ, অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঠিক পূর্বের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ প্রণয়ন করেন। তবে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে যথাযথভাবে পরামর্শ করে এবং পরামর্শের ভিত্তিতে এই আইন প্রণীত হয়নি। এর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসলে একই বছরের মে মাসে আঞ্চলিক পরিষদ তার সুপারিশ জানিয়ে সরকারকে আইনটি সংশোধন করতে অনুরোধ জানায়। এর পর পার্বত্য মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির বহু সভা অনুষ্ঠিত হবার পর অবশেষে ৩০ জুলাই ২০১২-এ তৎকালীন আইন মন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে আঞ্চলিক পরিষদের “১৩-দফা প্রস্তাব” সম্বলিত খসড়ার বিষয়ে ঐক্যমত্যে আসা হয় (Chakma, 2013; চাকমা, ২০১২)।
চাকমা (২০১২) অনুসারে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক পেশকৃত ২৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৩টির ব্যাপারে ঐক্যমত হয়। এতে আমার দেয়া একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়, যাতে কোরাম নির্ণয়ে পার্বত্য তিনটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান (আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সার্কেল) এর মধ্যে অন্তত দুটির উপস্থিতি বাধ্যবাধক করা (যা অবশেষে আইনী সংশোধনীতে গৃহীত হয়নি) ।
শেষোক্ত ৩০ জুলাই ২০১২ এর বৈঠকে আমি এবং আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা সরকারী প্রতিনিধিগণের সাথে প্রবল বাক-বিতন্দা ও যুক্তিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পরই কেবল ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভবপর হয় (চাকমা সার্কেলের প্রস্তাব সহ) । কিন্তু এরপরও কমিশন আইন সংশোধনের নাটকীয় কাহিনীর অবসান হয়নি, আরও চার বছর পর্যন্ত।
৩ জুন ২০১৩-তে, উপরোক্ত ১৩ দফা প্রস্তাবের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধান বাদ দিয়ে কাছে পাঠিয়ে দেয়। জুলাই ২০১২-এর বোঝাপড়ার সাথে এই অ-সংলগ্নতার পেছনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা অন্যতম প্রধান কারন বলে আমি মনে করি। তবে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিশ্বাস রয়েছে যে এর নেপথ্যে রয়েছে সরকারের জাত্যাভিমানী ও পাহাড়ি-বিদ্বেষী বিভিন্ন সরকারী বিভাগ ও সংস্থায় কর্মরত সিভিল ও সামরিক কর্মকর্তা। যদিও এই সন্দেহের পেছনে কোন দালিলিক প্রমাণ বা উৎসের কথা এই প্রবন্ধে আমি আলোচনা করছি না, এটাতে যে সত্যতা রয়েছে তা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, আমার জীবনের বিগত চার দশকের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে।
বাদ পড়া বিষয়ের মধ্যে রয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের “রীতি” শব্দটি, বর্ধিত কোরামের প্রস্তাব এবং কমিশনের এখতিয়ার-বহির্ভূত ভূমির প্রকারভেদের সঙ্কোচনের প্রস্তাব। সংসদীয় কমিটির সাথে সাক্ষাত করে আঞ্চলিক পরিষদ আপত্তি জানায় যে এই বিল উপস্থাপনে ১৩-দফা প্রস্তাবের বরখেলাপ করা হয়েছে। অন্য দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু বাঙালী-ভিত্তিক সংগঠন (যাতে অভিবাসী বা ‘‘সেট্লার” পরিবারের ব্যক্তিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ), যার মধ্যে রয়েছে পার্বত্য যুব ফ্রন্ট, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ও বাঙালী ছাত্র পরিষদ, দাবী করে যে ১৩-দফা প্রস্তাবানুসারে আইন প্রণীত হলে এতে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালীদের অধিকার খর্ব হয়ে যাবে (Chakma, 2013; চাকমা, ২০১২; চাকমা, ২০১৩)। উপরোক্ত বিপরীতমুখী দাবীর চাপে, এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারনে, অবশেষে খসড়া বিলটি ঐ অধিবেশনে পাস হয়নি, যার পর পরই সরকারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পুনরায় ক্ষমতা গ্রহনের ফলে, ২০১৬ সনে, অবশেষে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটে, যা নীচে বর্ণিত হল। সরকার, দেরীতে হলেও, আইনটি সংশোধন করে, এবং সংশোধনীতে, সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে, আঞ্চলিক পরিষদের দাবিনামা ও প্রস্তাবাবলীর ভিত্তিতেই বিধানাবলী অন্তর্ভুক্ত করে। তবে এর থেকে চাকমা সার্কেলের কোরাম সংক্রান্ত প্রস্তাবটি বাদ পড়ে যায়।
২। কমিশন আইনের ২০১৬ এর সংশোধনী
৯ আগস্ট ২০১৬-তে, আঞ্চলিক পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা সমূহ গ্রহনপূর্বক, ২০১৬ সনের ১নং অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) পাশ করার মাধ্যমে সরকার কমিশন সংক্রান্ত ২০০১ সনের আইন সংশোধন করে। এরপর ৬ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে, আগস্ট মাসে প্রনীত অধ্যাদেশ-টি একটি বিল প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৯৩ অনুসারে, সংসদ ভেঙ্গে গেলে বা সংসদ অধিবেশনে না থাকলে, রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারী করতে পারেন, এবং এরূপ অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতা সম্পন্ন বলে বিবেচিত। তবে অধ্যাদেশ জারীর পর সংসদের প্রথম অধিবেশনে তা সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত না হলে তার কার্যকারিতা লোপ পেয়ে যায়। তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮-এর বিধান বলে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে আইনগতভাবে বাধ্য।
৩। সংশোধনীর প্রেক্ষাপট
২০০১ সনের ভূমি কমিশন আইনটি প্রণয়নের পরপরই ১৯৯৭ এর চুক্তির বিধানের সাথে অসঙ্গতি থাকার কারনে আঞ্চলিক পরিষদ সরকারের কাছে তার আপত্তি জানিয়ে আইনটির সংশোধনের দাবী জানায়। এর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় বেশী দিন না থাকায় বিষয়টি ধামা চাপা পড়ে যায়। ২০০৯ সন থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট আবার ক্ষমতায় আসায় ইস্যুটি আবার জেগে ওঠে।
৩রা জুন ২০১৩ তে মন্ত্রীসভা সংশোধনী আইনের একটি খসড়া অনুমোদন করে, কিন্তু খসড়াটি বিল আকারে সংসদ কর্তৃক পাশ করা হয়নি। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, তবে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয় [দেখুন, যথাঃ Chakma (2013), চাকমা (২০১২) ও চাকমা (২০১৩)] । তবে মোটা দাগে যদি বলি, এতে দুটো প্রধান পক্ষের দ্বিমত ছিল। এক দিকে আঞ্চলিক পরিষদ বিরোধিতা করে, কারণ পরিষদের মতে খসড়াটিতে কিছু কাংখিত পরিবর্তন নিয়ে আনা হলেও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে বাদ পড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে আপত্তি আসে তার ঠিক বিপরীতধর্মী। মন্ত্রণালয়ের মূল বক্তব্য ছিল, শব্দে না হলেও মর্মে যে, পরিষদের প্রস্তাব গৃহিত হলে “রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব” খর্ব হয়ে যাবে, সুতরাং কমিশনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার, ও এর পাহাড়ি সদস্যগণের ভূমিকাকে, সীমিত করা হোক।
সংশোধনী আইনের খসড়া প্রণয়নে ও লবি-এডভোকেসির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এডভোকেট সুলতানা কামাল ও প্রখ্যাত কয়েকজন মানবাধিকারকর্মীর যৌথ নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, গৌতম দেওয়ান নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সহ আরও অনেক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ এই উদ্যোগে শরীক হন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাপেং ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মঙ্গল কুমার চাকমা। অবশ্য পুরো বিষয়টিতে দিকনির্দেশনামূলক নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (“সন্তু লারমা”) ।
নেপথ্যে আরও অনেকেই অবদান রেখেছেন, তাত্ত্বিকভাবে, ধারনাটির উদ্ভবের ক্ষেত্রে, খসড়া প্রণয়নে, ও সীমিতভাবে, লবি-এডভোকেসির ক্ষেত্রে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অত্র লেখকের ভূমিকা নিয়ে একটি বিষয় উল্লেখ করতে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করছি। তাই খুব সংক্ষেপে এটাই শুধু বলব যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ সাক্ষরিত হবার পূর্বে ও পরবর্তীকালে, বিভিন্নভাবে, এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে, আমি এ বিষয়ের সাথে জড়িত ছিলাম।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিষয়ে অন্তীম পর্যায়ের আলোচনার অনেক পূর্বে, বিচারিক ক্ষমতা-সম্পন্ন একটি ভূমি কমিশনের প্রতিষ্ঠার বিষয় আমি সরকারের কাছে তুলে ধরি এবং কিছু লেখালেখিও করি। এক পর্যায়ে জনসংহতি সমিতি তা গ্রহন করে তাদের দাবীনামার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে। তবে, একটি বিষয়ে কোন ধরনের অস্পষ্টতা থাকা উচিত না। ধারনাটির উদ্ভবের সাথে আমি যতখানি জড়িত থাকিনা কেন, ১৯৯৭-এর চুক্তিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সাবলীল ও নেতৃত্বশীল ভূমিকা না থাকতো, বিষয়টি চুক্তিতেও আসতো না, আর ভূমি কমিশনও আদৌ গঠিত হতো না।
৪। মূল আইন ও সংশোধিত আইনের পার্থক্য
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন সংক্রান্ত ২০০১ সনের মুল আইন ও ২০১৬ সনের সংশোধনীর পরের আইনে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সংক্ষেপে উল্লেখ করলে, অন্যান্যের মধ্যে, এগুলো হলো: (১) কমিশনের এখতিয়ার (কার্যাবলী ও ক্ষমতা); (২) পার্বত্যাঞ্চলে প্রচলিত অলিখিত প্রথা, রেওয়াজ ও পদ্ধতির প্রযোজ্যতা; (৩) চেয়ারম্যানের ক্ষমতা; (৪) কোরাম; এবং (৫) সার্কেল প্রধানদের (রাজাদের) প্রতিনিধি প্রেরণের বিষয়। নীচে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংক্ষেপে বর্ণিত হলো।
৪(১)। কমিশনের এখতিয়ার
কমিশনের এখতিয়ারে কোন কোন শ্রেণীর ভূমি অন্তর্ভুক্ত এবং কোন কোন শ্রেণীর ভূমি বহির্ভূত রাখা হয়, তা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। যেহেতু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকাকে কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়, কর্ণফুলী জলাশয়ের জলে ভাসা জমি বা Fringe Land সমূহ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিনা প্রশ্ন রয়ে যায়। তাই, এসব শ্রেণীর জমির প্রত্যক্ষ উল্লেখের মাধ্যমে বিষয়টি খোলসা করা হয় [সংশোধিত ধারা ৬(১)(গ)] । এছাড়া, পূর্বে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা সহ বেতবুনিয়া ভু-উপগ্রহ কেন্দ্র, সংরক্ষিত বন (রিজার্ভ ফরেস্ট) এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের নামে অধিগৃহীত বা রেকর্ডকৃত ভূমি কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়। সংশোধনীর পর রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকাসমূহের বিরোধ কমিশনের এখতিয়ারে আনা হয়, এবং সরকারী ভূমির মধ্যে কেবল যেগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক অধিগৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয় [সংশোধিত ধারা ৬(১)(গ) এর অনুবিধি বা Proviso] ।
৪(২)। পার্বত্যাঞ্চলে প্রচলিত অলিখিত প্রথা, রেওয়াজ ও পদ্ধতির প্রযোজ্যতা
পূর্বেকার আইনে লেখা ছিল যে কমিশন “পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন ও রীতি” অনুসরণ করে বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। সংশোধিত আইনে এর সাথে “পদ্ধতি” শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে [সংশোধিত ধারা ৬(১)(ক); ৬(১)(খ) ও ৬(১)(গ)]। যদিও পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ অনুসারে কমিশনটি ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ সহ সব ধরনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কথা ছিল, ২০০১ সনের আইনের সাধারণ পঠন থেকে মনে করা অস্বাভাবিক নয় যে কমিশন কেবল শরণার্থীদের বিরোধ দেখবে। তাই ২০১৬ সনের সংশোধনীতে এবিষয়টির প্রশ্নাতীতভাবে স্পষ্টীকরণ আনা হয় [সংশোধিত ধারা ৬(১)(ক)]।
৪(৩)। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা
মুল আইনটিতে এমন বিধান রাখা হয় যে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত থাকলে চেয়ারম্যানের মতামতই কমিশনের সিদ্ধান্ত মর্মে বিবেচিত হতো। তা পালটিয়ে এখন এরূপ দ্বিমত থাকল, কমিশনের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতকে কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেয়া হবে [সংশোধিত ধারা ৭(৫)]।
৪(৪)। কোরাম
কোরামের নিয়মটি পূর্বে এমন ছিল যে, সংশ্লিষ্ট জেলা বা সার্কেলের ক্ষেত্রে, কমিশনের চেয়ারম্যান সহ মোট পাঁচ জনের তিনজন নিয়ে কোরাম পূর্তি হতো। বর্তমানে কোরাম হচ্ছে চারজন সদস্য [সংশোধিত ধারা ৭(৩)]। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী বিষয়ের ক্ষেত্রে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম মিলে কমিশনের মোট নয়জন সদস্য হলেও, বিচারকার্যের সময় যখন এলাকাগত এখতিয়ার অনুসারে কমিশন তিনটি সার্কেল ও তিনটি জেলার জন্য আলাদা আলাদাভাবে বসবে, তখন কেবল সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট সার্কেল প্রধান সম্পৃক্ত থাকবেন, এবং তাঁদের সাথে কমিশনের চেয়ারম্যান, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় কমিশনার বা অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার যুক্ত হবেন।
৪(৫)। সার্কেল প্রধান বা রাজাদের প্রতিনিধি প্রেরণ
সার্কেলের প্রধান বা রাজারা আগে স্বয়ং উপস্থিতির মাধ্যমে কমিশনে ভূমিকা রাখতে বাধ্য ছিলেন। বর্তমানে, তাঁরা, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় কমিশনারের ন্যায় প্রয়োজনে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবেন [সংশোধিত ধারা ২(ঘ)]। এর পেছনে যৌক্তিকতা হচ্ছে, রাজাদের দাপ্তরিক ব্যস্ততার বিষয়, এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল যে, এর মাধ্যমে রাজাদের বার্ধক্য বা অসুস্থতার কারণে যাতে কমিশনের কাজ ব্যহত না হয়। প্রসঙ্গক্রমে, বোমাং সার্কেলের রাজপ্রথার কারণে বোমাং রাজপদে সাধারণত বৃদ্ধ বয়সের ব্যক্তিরাই অধিষ্ঠিত হন।
৪(৬)। অন্যান্য পরিবর্তন
উপরোক্ত পরিবর্তন ছাড়া আরও কিছু বিষয়ে ২০১৬-র সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন সাধিত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোঃ (ক) যে কোন এলাকায় কমিশনের শাখা অফিস খোলার স্বাধীনতা (কেন্দ্রীয় অফিস মুল আইনের অধীনে খাগারাছরির জেলা সদরে অবস্থিত); (খ) দাখিলকৃত আবেদন একবার সংশোধনের সুযোগ; (গ) কমিশনের সচিব ও সচিবালয়ের অন্যান্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে “উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদানক্রমে” অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ; ইত্যাদি।
৫। পুনর্গঠিত কমিশনের বৈঠক
৯ই আগষ্ট, ২০১৬ তারিখে সংশোধনী আইন প্রণয়নের পর কমিশন মোট ছয়টি বৈঠক করে। ০৪/০৯/২০১৬, ৩০/১০/২০১৬, ১৬/০১/২০১৭, ১৮/০২/২০১৮, ২৭/০৬/২০১৮ ও ২৭/০৬/২০১৮ তারিখে। আজ অবধি একটি বিরোধও মীমাংসিত হয়নি। তবে তা আশ্চর্যের বিষয় নয়। কমিশনের জনবল ও লজিষ্টিক্স-এর ক্ষেত্রে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। মূল আইনের অধীনে সম্পূরক বিধি এখনও প্রণীত হয়নি। এবং বিরোধের সংখ্যা ২৩, ০০০ এরও অধিক।
এছাড়া, অন্যান্যের মধ্যে, (ক) বিরোধসমূহের প্রকারভেদ (বন্দোবস্তি, ইজারা, হস্তান্তর বা অধিগ্রহণ, দখল, বেদখল বা দখল পুনর্বহাল সংক্রান্ত), (খ) পক্ষগণের প্রকারভেদ (এতে একাধিক সরকারী বিভাগ ও সংস্থা, বেসরকারি ব্যক্তি ও সংস্থা, বেসরকারি কোম্পানি, পাহাড়ি ও বাঙালী ব্যক্তি, পাহাড়ি সামষ্ঠিক সম্প্রদায় ও অন্যান্য নানাবিধ সামষ্টিক সত্ত্বা জড়িত রয়েছে), (গ) সত্ত্বার প্রকারভেদ (ব্যক্তিগত মালিকানা, সংস্থার ইজারা, প্রথাগত সামষ্টিক স্বত্বাধিকার, ইত্যাদি) ও নানাবিধ ইস্যু জড়িত থাকায়, এসব বিষয়ে যথাযথ তথ্য, আইন, প্রথা ও রীতি সম্পর্কে উপলব্ধি, স্বাক্ষী-প্রমাণ সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট, ইত্যাদির ক্ষেত্রে কমিশনের সদস্য ও কর্মকর্তাগনের সম্যক ধারনা আয়ত্তে না আনা ও এ ব্যাপারে মতৈক্য না আসা পর্যন্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জটিল কাজে হাত দেয়া যথাযথ হবে না। সুতরাং বিরোধ নিষ্পত্তি শুরু হয়েও বিরোধ দীর্ঘ সময় ধরে গড়াতে পারে। এতে আইনটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ভূমি বিরোধের দ্রুত নিষ্পত্তি দেয়া, ব্যহত হতে পারে।
কমিশনের ১৬/০১/২০১৭ তারিখের বৈঠক পর্যন্ত ২২, ৮৮১ টি আবেদন দাখিলকৃত হয়েছে। কিন্তু কমিশনের জনবল, কারিগরি সরঞ্জাম (যানবাহন, কম্পিউটার, অন্যান্য অফিস আসবাবপত্র ও যন্ত্রাদি) ইত্যাদি আয়ত্তে না আসলে কমিশন তার কাঙ্খিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হবে। এ সমস্ত ঘাটতি পুরণের জন্য কমিশন সরকারের নিকট আহবান জানিয়েছে। ইতোমধ্যে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহ তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে যানবাহন, কম্পিউটার ইত্যাদির ক্ষেত্রে যথাযথ যোগানের পদক্ষেপ গ্রহন করেছে।
৬। জুন ২০১৭ থেকে জুন ২০১৮ এর মধ্যেকার সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী
আমি এই লেখার প্রথম দিকে বলেছিলাম যে এই লেখাটি মূলত: জুন ২০১৭-তে মালেইয়া ফাউণ্ডেশন ও সিআইপিডি কর্তৃক প্রকাশিত আমার একটি পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত অধ্যায়ের ভিত্তিতেই রচিত। তাই জুন ২০১৭ থেকে জুন ২০১৮ এর মধ্যবর্তী সময়ের প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর আপেডেট আনা প্রয়োজন (যা আমার প্রকাশিত পুস্তকে পাওয়া যাবে না) ।
প্রথমত: কমিশন সংশ্লিষ্ট বিরোধসমূহকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করে (আমার প্রস্তাবে), যা অধ্যায় ৭(১)-এ নীচে আলোচনা করেছি।
দ্বিতীয়ত: কমিশন তার ২৭/০৬/২০১৮ তারিখের বৈঠকে ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরনার্থীদের বিরোধসমূহকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। এর সাথে আভ্যন্তরীন পাহাড়ী উদ্ধাস্তুদের বিষয়কেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
তৃতীয়ত: কমিশন প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত কিছু সংখ্যক বিরোধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সার্কেল প্রধান ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানগণের মতামত আহ্বান করেছে। প্রসঙ্গত, ২৭/০৬/২০১৮ তারিখের সর্বশেষ বৈঠকে আমি আমার দপ্তরে কমিশন কর্তৃক প্রেরিত রাঙামাটি সদর উপজেলার ২০০-টি আবেদনের বিন্যাশ নিয়ে ব্রিফিং উপস্থাপন করি (অন্যান্য সার্কেল প্রধান এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানগণ এ বিষয়ে তাদের স্ব স্ব এলাকার ব্রিফিং এখনও পর্যন্ত প্রদান করেননি) ।
চাকমা সার্কেল অফিসে প্রেরিত সদর রাঙামাটি উপজেলার ২০০ মামলার মধ্যে দেখা যায় যে কমিশন কর্তৃক চিহ্নিত নয় (৯) প্রকারের বিরোধের মধ্যে দুই প্রকারের বিরোধের, ব্যক্তি বনাম ভূমি ইজারা গ্রহণকারী (শ্রেণী নং ৩) ও ব্যক্তি বনাম গ্রামীণ জনগোষ্ঠী (শ্রেণী নং ৭) শ্রেণীর কোন বিরোধ এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বনাম ব্যক্তি বা সংস্থা (শ্রেণী নং ২), গ্রামীন জনগোষ্ঠী বনাম সরকারী সংস্থা (শ্রেণী নং ৮), ব্যক্তি বনাম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (শ্রেণী নং ৪) ও ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি (শ্রেণী নং ৬) শ্রেণীসমূহ থেকে দরখাস্ত পাওয়া গেছে যথাক্রমে, ১, ১, ২ ও ৫-টি। সর্বাধিক দরখাস্ত এসেছে ব্যক্তি বনাম সরকারী সংস্থা (শ্রেণী নং ১) ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বনাম সরকারী প্রতিষ্ঠান (শ্রেণী নং ৫) শ্রেণী থেকে, যার সংখ্যা ছিল, যথাক্রমে, ৯২ ও ৯৭-টি।
রাঙামাটি সদর উপজেলাতে ভূমি ইজারা, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী, আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তু, ইত্যাদি শ্রেণীর বিরোধ না থাকা বা কম থাকাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। দীঘিনালা, পানছরি ও মাটিরাঙা উপেজেলার দরখাস্তগুলোতে নিশ্চয় প্রাক্তন শরণার্থীদের অনেক বিরোধ থাকবে। আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের বিরোধ নিঃসন্দেহে বাঘেইছরি উপজেলার সাজেক ইউনিয়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য একাধিক উপজেলাতে রাঙামাটি সদর উপজেলার চেয়ে বেশী হবে, যেমনটি ইজারার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী বিরোধ থাকার কথা বান্দরবান জেলায়। সমষ্টিগত প্রথা-ভিত্তিকভাবে ব্যবহৃত জমির বিরোধ (শ্রেণী নং ৮) নিশ্চয় “প্রত্যন্ত” এলাকা থেকে সদরের কাছের এলাকাগুলো থেকে অনেক বেশী হবে। যখন অন্যান্য উপজেলার দরখাস্তগুলো পাওয়া যায় (সংগ্রহের কাজ চাকমা সার্কেলে চলমান রয়েছে, তার দাপ্তরিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও), তখন এসব শ্রেণীর বিরোধ নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখি।
চতুর্থত: রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা সদরে দুটো শাখা কার্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে কমিশনের প্রস্তাবের সরকারী অনুমোদন আসার ফলে শাখা কার্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যদিও আপাত: ভাড়া করা কক্ষে অফিসসমূহ থাকবে (মূল কার্যালয়টি খাগড়াছড়ি জেলা সদরে অবস্থিত) ।
পঞ্চমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক সরকারের নিকট প্রেরিত প্রস্তাবিত বিধিমালার খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে মর্মে বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে। উক্ত বিধি প্রণীত হলে কমিশনের কার্যপ্রণালী আরও সুদৃঢ় ও ফলাফলমুখী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বলাবাহুল্য, কমিশনের সফলতা বা বিফলতা নির্ভর করবে এর সদস্যদের ভূমিকার উপর, এবং সদস্যদের ভূমিকা বলিষ্ঠ ও কার্যকর হতে হলে প্রয়োজন হবে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণা, তথ্য বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্য পক্ষগণের ও সহায়কজনের (যথা: হেডম্যান ও কার্বারীগণের) প্রশিক্ষণ। এসব বিষয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সাথে মিলে চাকমা সার্কেল ক্ষুদ্র পরিষরে কিছু কাজ হাতে নিয়েছে।
ষষ্ঠত: কমিশনের কাজের সাফল্য সার্বিক ক্ষেত্রে এর সচিবালয়ের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কমিশন জনবল ও প্রয়োজনীয় দপ্তর সামগ্রী বৃদ্ধির জন্যেও সরকারের কাছে আবেদন করেছে। বর্তমানে সচিবালয়ে কেবল একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা রয়েছে এবং অফিস সামগ্রীর ব্যাপারেও অপ্রতুলতা রয়েছে। সার্কেল ও জেলা ভিত্তিকভাবে, এবং চিহ্নিত শ্রেণী অনুসারে বিরোধের দরখাস্ত সমূহ বিন্যস্তকরনে সচিবালয় হিমসিম খাচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবেনা। কাজেই এ বিষয়েও অগ্রগতি না হলে কমিশনের বিরোধ নিষ্পত্তির কাজে বিলম্ব হতে পারে।
৭। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের ব্যাপ্তি ও প্রকারভেদ
সংশোধিত কমিশন আইনের বিধানানুসারে কমিশন কর্তৃক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এর এখতিয়ারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে কমিশন (ক) বিরোধের যে কোন পক্ষের (অর্থাৎ আবেদনকারী বা প্রতিপক্ষের) “সত্ত্ব বা অন্যবিধ অধিকার” নির্ধারণ করতে পারবে [ধারা ৬(১)(খ)]; (খ) “দখল পুনর্বহাল” করতে পারবে [ধারা ৬(১)(খ)]; (গ) বেআইনী বন্দোবস্ত এবং বেআইনী অধিগ্রহন “বাতিল” করতে পারবে [ধারা ৬(১)(গ)]; এবং উপরোক্ত তিন ক্ষেত্রেই, কমিশন “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি” অনুসরণ করবে [ ধারা ৬(১)(ক), ৬(১)(খ), এবং ৬(১)(গ)]।
কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে রয়েছে: (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি; এবং (খ) বেআইনীভাবে অধিগ্রহনকৃত, বন্দোবস্তীকৃত এবং বেদখলকৃত ভূমি, বসত বাড়ি, জলে ভাসা ভূমি (Fringe Land), টিলা ও পাহাড় [ধারা ৬(১)(ক), ৬(১)(খ), এবং ৬(১)(গ)]। কেবল তিন শ্রেণীর ভূমি এর এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে; কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা; বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা; এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের “আইন, প্রথা ও রীতি” অনুসরণে অধিগৃহীত ভূমি [ধারা ৬(১)(গ) এর শর্তাংশ (proviso)]।
সুতরাং কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজে বিভিন্ন প্রকারের পক্ষ, ভূমির মালিকানা, দখল ও অন্যান্য ধরনের স্বত্ত্বের প্রকারভেদ, ভূমির দখল ও বেদখলের অবস্থার ও মর্যাদার প্রকারভেদ, ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে।
৭.১. বিরোধের পক্ষগণের প্রকারভেদ
ভূমি কমিশনের নানান প্রকারের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে পক্ষগণের ক্ষেত্রে যেমন প্রকারভেদ থাকবে, ভূমির প্রকৃতির, মালিকানার, দখল ও দখলসত্ত্বের এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকারভেদের ব্যপকতাও থাকবে। পক্ষগণের দিকে এক নজরে তাকালে দেখা যাবে যে এতে, দরখাস্তকারী বা প্রতিপক্ষ হিসেবে, নানান ধরনের আইনী সত্তা রয়েছে, যথাঃ (ক) সামষ্টিক জনগোষ্ঠী; (খ) ব্যক্তি; (গ) বিভিন্ন ধরনের সরকারী সংস্থা; (ঘ) বেসরকারী কোম্পানি বা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান; প্রভৃতি। কমিশন কর্তৃক বিভাজিত নয় (৯) শ্রেণীর বিরোধের কথা উপরে অধ্যয় ৬-এ সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের ও এনজি সমূহের সহায়তায় চাকমা সার্কেল বিভিন্ন ধরনের শ্রেণিবিন্যাস সহ ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে, যার কিছু অংশ আমার ২০১৭-এ প্রকাশিত বইয়ে (রায়, ২০১৭) মুদ্রিত হয়েছে এবং এই প্রবন্ধের non-facebook ভার্শনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফেসবুক নোটে সারণি আনতে বিফল হওয়ার ফলে আমি এগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। ইমেলে যোগাযোগ করলে শেয়ার করতে পারবো।
কমিশনের ০৪/০৯/২০১৬ তারিখের বৈঠকে আমার প্রস্তাবের ভিত্তিতে কমিশন বিরোধসমূহকে নয়টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে, যথা (১) ব্যক্তি বনাম সরকারী সংস্থা; (২) ভারত প্রত্যাগত শরনার্থী বনাম ব্যক্তি বা সংস্থা; (৩) ব্যক্তি বনাম ভূমি ইজারা গ্রহণকারী; (৪) ব্যক্তি বনাম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান; (৫) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বনাম সরকারী প্রতিষ্ঠান; (৬) ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি; (৭) ব্যক্তি বনাম গ্রামীন জনগোষ্ঠী; (৮) ব্যক্তি বা গ্রামীন জনগোষ্ঠী বনাম সরকারী সংস্থা; এবং (৯) আভ্যন্তরীন উদ্ধাস্তু বনাম ব্যক্তি বা সংস্থা।
এই প্রস্তাবের পেছনে রয়েছে সংশ্