সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ প্রত্যয়ন দিয়ে আলোচনায় জামায়াত আমীর রাবিপ্রবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত, নেতৃত্বে সেতু-জনি জেলা প্রশাসককে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিদায় সংবর্ধনা জেলা প্রশাসককে বদলিজনিত কারনে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালো রাঙামাটি প্রেস ক্লাব লক্ষীছড়ির দুর্গম গ্রামে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করলো গ্রীন হিল
দেশের পার্বত্য জনপদ রাঙামাটির কথাই বলি। ক'দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও চোখে পড়ল। ভিডিওচিত্রে একজনকে বলতে শোনা গেলো এটিই রাঙামাটি শহরের সবচেয়ে বড় পূজা মণ্ডপ। তখন ওই ভিডিওচিত্রে পোস্টটির কমেন্টে দেখা গেল কয়েকজন লিখেছেন, 'এটা যদি সবচেয়ে বড় পূজা হয় তাহলে অন্যগুলো কি ছোট?' এই প্রশ্নটি আমার কাছেও খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এই ছোট পূজা-বড় পূজা প্রসঙ্গে মানুষ আসলে কী ভাবেন। কে কিভাবে ভাবেন, কোন মানদণ্ডে মূল্যায়ন করেন এটি নিয়ে আমারও জানার প্রবল আগ্রহ।
ওই ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরেই যদি বলি, অনেকেই মনে করেন ওই মণ্ডপেই জেলার সবচেয়ে বড় পূজা মণ্ডপ। কারণ পুরো জেলার যে কয়টি মণ্ডপে পুজো হয় তারমধ্যে জেলা শহরের পুজোগুলো অনেক জাঁকজখমপূর্ণ, ব্যাপক আলোকসজ্জার ঝলকানিতে হয়। এরমধ্যে এই মণ্ডপের আয়োজনই সবার শীর্ষে থাকে বলে মত অনেকের। তাহলে এই ছোট-বড় পূজার প্রসঙ্গটা এলো কোথা থেকে? সেই ভাবনার বিষয়টি কিছুটা এখান থেকে আঁচ পাওয়া যায়।
কেবল বাংলাদেশেই নয়; ওপাড় বাংলা অর্থাৎ ভারতেও এই ছোট পূজা, বড় পূজা নিয়ে ভেদাভেদ তৈরি হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরেই। মূলত মানুষ এই মূল্যায়নটা কবে থেকে করছে, মূল্যায়নটা কবে থেকে শিখেছে? বস্তুত মানুষের মধ্যকার এই মূল্যায়ন অনেকটা পুজোর অর্থব্যয় আর ঝমকালো আলোকসজ্জা আর আয়োজন ঘিরেই দিনেদিনে বাড়ন্ত হয়েছে।
পুজোর সময় মহালয়া থেকে শুরু করে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং বিজয়া দশমী পর্যন্ত পুজোর যে আনুষ্ঠানিকতা থাকে, সেই আনুষ্ঠানিকতা সব মণ্ডপেই সমানভাবেই করা হয়। পুজো আয়োজনের জন্য কোনো অংশে কমতি রাখেন না ভক্তবৃন্দ থেকে শুরু করে আয়োজক কমিটি। পুজোর সব আয়োজন সমানতালে, সময়বিধি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত করা থেকে শুরু করে বিজয়া দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত সব আচার অনুষ্ঠান একই হওয়াত পর এই ছোট বড় পুজোর ভেদাভেদ করলো কারা?
বাংলাদেশের পুজোর প্রেক্ষিতে যদি বলি, এদেশে এমনও পুজো হয় যেখানে কয়েক লাখ টাকা অর্থ ব্যয় করে করা হয়। আবার অনেক মণ্ডপেও পুজোর আয়োজন হয় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে। কোটি কোটি টাকা, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ের এইসব পুজোত্র থাকে নানান রকমের মনকাড়া থিম। থাকে দেবীর হাজার হাজার প্রতিমাও। পুজোর এই আয়োজন এখন প্রতিযোগিতা হয়েছেও দাঁড়িয়েছে। কোন মণ্ডপ কার থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করবে কত বেশি আয়োজন করবে সেটি নিয়েও প্রতিযোগিতার শেষ নেই। আবার কোথাও হচ্ছে জাঁকজখমওয়ালাদের ভাষ্যের 'সিম্পল পুজোর' আয়োজন৷ পুজোর এই ছোট বড় এর ভেদাভেদ এসেছে এসব থেকেই।
মানুষের মধ্যে দিনদিন উৎসব ও আনন্দ আয়োজন নতুন করে বেড়েছে তা কিন্তু নয়। আনন্দ আয়োজন আর উৎসবের এই ঘটা পরিবেশ আগেও ছিল। হয়তো আগের চিত্র কিছুটা পাল্টেছে। মানুষ আগেও পুজোতে আনন্দ করতেন, এখনো করেন। কিন্তু আগের চেয়ে এখন ঢাক-ঢোলের বাদ্য-বাজনা কমে গেছে। শহরের মণ্ডপগুলোতে পুজো দেখলে গেলে এমনও হবে আপনি ২০টা মণ্ডপ ঘুরেও ঢাক-ঢোলের বাজনা শুনতে পাবেন না। আবার এখনকার দিনে নতুন নতুন থিম পুজোর প্রবণতা বেড়েছে। নানান রঙের, ডিজাইনের, আয়োজনে এসব পুজোর আয়োজন হচ্ছে। কোথাও কৃত্রিম ভূমিকম্পের আয়োজন আবার কোথাও কোথাও পড়ছে পাহাড় চূড়া থেকে ঝর্ণার পানি। এইসব কিছুই মূলত ভক্তদের আনন্দ দেবার জন্য। নিজেদের আনন্দের জন্য, দর্শনার্থী বাড়ানোর জন্য। কিন্তু যার জন্য পুজো আয়োজন। যাকে করছেন পুজো তিনি কি এই বাড়তি আয়োজনে বেশি সন্তুষ্ট হচ্ছেন?
বাংলাদেশে মূলত পুজোর এই ছোট-বড় এর হিসাব, ভেদাভেদ এসেছে অর্থের ব্যয়বহুলতা থেকেই। যেই মণ্ডপে যে আয়োজক কমিটি যতবেশি আয়োজন আর জমকালো সাজসজ্জা করছে মানুষ সেটিকেই বড় পুজো ছোট পুজো বলতে শিখেছে। কিন্তু এটি নতুন করেই শুরু হয়েছে তাও কিন্তু না। এটিই দীর্ঘদিনের যাত্রা। দীর্ঘদিন ধরেই এই ঐতিহ্যকে মানুষ বহন করে আসছে সানন্দেই। গ্রামের পুজো আর শহরের পুজোর ভেদাভেদ তৈরি হয়েছে এই অর্থই। কথায় আছে অর্থই সকল অনর্থের মূল। পুঁজি আর অর্থের প্রভাব পড়েছে খোদ ধর্মীয় রীতিনীতি চর্চার ক্ষেত্রেও।
শারদীয় দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবকে বলা হয় সর্বজনীন উৎসব। সর্বজনীন বলতে সবার কিংবা সকলের অংশগ্রহণও। বাংলাদেশে অনেক পরিবার আছেন যারা ব্যক্তি উদ্যোগ কিংবা পারিবারিকভাবেই পুজোফ আয়োজন করেন। একাই সব খরচ ব্যয়ভার সামলান। এসব পরিবারের অঢেল সম্পদ থাকার কারণে তারা সাধারণ মানুষ বা সাধারণ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে পুজোর চাঁদাও তেমন নেন না বা গ্রহণ করেন না। নিজেদের আছে বলেই নিজেরাই ব্যয় করেন। কিন্তু দিনশেষে আপনার পুজোতে যদি মানুষের অংশগ্রহণ আর সম্পৃক্ততা না থাকে সেটি সর্বজনীন পুজো আদৌ হবে?
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই সর্বজনীন পুজো আর ছোট-বড় পুজোর ভেদাভেদ ভাঙতে হবে। বড় পুজোর নামে টাকার অহমিকা, অহংকার কখনো দেবীকে বাড়তি সন্তুষ্ট করবে না। পুজো হোক উৎসবের, আনন্দের ও সর্বজনীন।
লেখক: সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী