পাহাড়ের আঞ্চলিক দলে রাজনীতিতে বিরোধ, ভোটে ঐক্য
প্রকাশঃ ১৮ মে, ২০২৪ ০৬:৪৩:৫৪
| আপডেটঃ ০৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:০৬:১৪
|
১৩৪৮
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবাদমান চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যকার রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিরোধের মধ্যেও স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন ঘিরে নতুন মেরুকরণ হয়েছে। রাজনৈতিক বৈরিতার মধ্যেই ভোটকে ঘিরে ঐক্য করেছে পাহাড়ের প্রধান দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে নির্বাচনের ‘সুষ্ঠু পরিবেশ নেই’ বলে ভোটে অংশগ্রহণ না করলেও উপজেলার ভোটে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির জানান দিতে চাইছে আঞ্চলিক দলগুলো। বিশেষত ইউপিডিএফ-জেএসএসের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেই একমুখী অবস্থান নিয়েছে দল দু’টি।
পাহাড়ে বর্তমানে সক্রিয় চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস); প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিফিএফ); বিমল কান্তি চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও শ্যামল চাকমার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (গণতান্ত্রিক) পরিচালিত হচ্ছে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দৃশ্যত চারটি আঞ্চলিক দল দুইটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে আছে। কৌশলগত কারণে জাতীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকেও নির্বাচনে সমর্থন দেওয়ার কথা বলছে তারা। এরমধ্যে ইউপিডিএফ-জেএসএস একমুখী অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এমএন লারমা) বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। মূলত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটির সঙ্গে জেএসএস (এমএন লারমা)-এর রাজনৈতিক সখ্যতা রয়েছে। তবে পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া সন্তু লারমার জেএসএস ও চুক্তির ঘোরবিরোধীতা করা প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের মধ্যকার রাজনৈতিক মতানৈক্য ও বিরোধ দৃশ্যমান। ভোট ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেও ঐক্য হয়েছে জেএসএস-ইউপিডিএফের।
তৃতীয় ধাপের ভোটে ৩ উপজেলায় প্রার্থী যারা:
আগামী ২৯ মে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও লংগদু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আয়তন ও ভৌগলিকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি। উপজেলাটিতে আগামী ২৯ মে তৃতীয় ধাপের অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ৯ জন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ঘোড়া প্রতীকে বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা ও আনারস প্রতীকে বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের সদ্য-সাবেক চেয়ারম্যান অলিভ চাকমা ভোটে লড়ছেন। সুদর্শন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও অলিভ চাকমা জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ-সভাপতি।
ভাইস চেয়ারমানে পদে এ উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন পাঁচজন; তারা হলেন বই প্রতীকে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম, তালা প্রতীকে দীপ্তিমান চাকমা, উড়োজাহাজ প্রতীকে নিখিল জীবন চাকমা, চশমা প্রতীকে মো. আনোয়ার হোসেন ও টিউবওয়েল প্রতীকে লড়ছেন মো. মনসুর আলী। অন্যদিকে, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সাগরিকা ফুটবল প্রতীক ও সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুমিতা চাকমা প্রজাপতি প্রতীকে। ভোটাররা বলছেন, মূলত দুজন করে প্রার্থী হওয়ায় চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দৃঢ় ভোটযুদ্ধ হবে বাঘাইছড়িতে।
নানিয়ারচর উপজেলায় মোট প্রার্থী হয়েছেন ৮ জন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা কাপ-পিরিচ, রুপম দেওয়ান দোয়াত-কলম, জ্যোতিলাল চাকমা মোটর-সাইকেল ও অমর জীবন চাকমা আনারস প্রতীকে লড়ছেন। চারজনের মধ্যে প্রগতি চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) রাঙামাটি জেলা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, রুপম দেওয়ান বর্তমান উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। জ্যোতিলাল চাকমা নানিয়ারচর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও অমর জীবন চাকমা ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। জ্যোতিলাল ও অমর জীবন দুজনই ইউপিডিএফের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে সুজিত তালুকদার টিউবওয়েল ও বিনয়কৃঞ্চ চাকমা বই প্রতীকে লড়ছেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা প্রজাপতি ও অনিতা চাকমা কলস প্রতীকে লড়ছেন।
অন্যদিকে, লংগদু উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার ঘোড়া প্রতীক, বাবুল দাশ (বাবু) আনারস প্রতীক, বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দোয়াত কলম ও প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান আবছার আলী মোটর-সাইকেল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। তাদের মধ্যে আব্দুল বারেক সরকার লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বাবুল দাশ বাবু বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বর্তমান সহ-সভাপতি। অন্যদিকে আবছার আলী এক সময় রাঙামাটি জেলায় বাঙালি জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠন ‘সম-অধিকার আন্দোলনের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন টিউবওয়েল প্রতীকে তোফায়েল আহমেদ বাবুল, বই প্রতীকে রকিব হোসেন ও চশমা প্রতীকে কল্যাণ প্রিয় চাকমা। অন্যদিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারা বেগম ফুটবল প্রতীকে ও ফাতেমা জিন্নাহ কলস প্রতীকে।
ভোটের মাঠে কার পক্ষে কে:
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন সুদর্শন চাকমা ও অলিভ চাকমা। এরমধ্যে সুদর্শনের প্রতীক ঘোড়া আর অলিভের প্রতীক আনারস। অলিভ চাকমা চাকমা রাঙামাটি জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ-সভাপতি আর সুদর্শন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক। সুদর্শন চাকমা বর্তমানে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং তৃতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কেবল পঞ্চম ধাপে উপজেলাটিতে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন বড়ঋষি চাকমা; তিনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসের নেতা এবং দলের সমর্থনেই নির্বাচন করেছিলেন।
নির্বাচনে এই উপজেলায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাষ মেরুকরণ বরাবরের মতোই বৈচিত্র্যময়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) প্রার্থী হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিশাল অংশের সমর্থন পাচ্ছেন সুদর্শন চাকমা। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও উপজেলায় ইউপিডিএফ-জেএসএসের পূর্ণ সমর্থনে ভোটের মাঠে নেমেছেন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা অলিভ।
নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ভোট করছেন বর্তমান চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা, রুপম দেওয়ান, জ্যোতিলাল চাকমা, অমর জীবন চাকমা। এরধ্যে প্রগতি চাকমা জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সাবেক নেতা এবং রুপম দেওয়ান বর্তমানে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক; যদিও দলের সমর্থনই পাননি রূপম। অন্য দুজন হলেন জ্যোতিলাল চাকমা ও অমর জীবন চাকমা। তারা দুজনই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপিডিএফের ঘরানার হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তবে শেষাবদি দুজনের একজনই পাচ্ছেন ইউপিডিএফের দলীয় সমর্থন।
লংগদু উপজেলায় আঞ্চলিক রাজনৈতিকদলগুলোর কোনো প্রার্থী নেই। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আনারস প্রতীকের প্রার্থী বাবুল দাশ বাবুকে সমর্থন দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। তবে উপজেলায় শক্ত সাংগঠনিক অবস্থানে থাকা জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সমর্থিত ভোট কার ঝুলিতে ঢুকবে সেটি এখনো ধোঁয়াশায় রয়েছে।
কোন উপজেলায় কত ভোট:
তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠেয় রাঙামাটির তিন উপজেলার মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮১ জন। বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৭৮ হাজার ২৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৪০ হাজার ৭৯৬ জন, নারী ভোটার ৩৭ হাজার ২৩২ এবং হিজড়া রয়েছেন ১ জন। ভোটকেন্দ্র ৩৯টি। লংগদু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬১ হাজার ২৬৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৩১ হাজার ৮৭৭ জন, নারী ভোটার ২৯ হাজার ৩৮৬। ভোটকেন্দ্র ২৩টি। নানিয়ারচর উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬৮৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১৯ হাজার ৮৩২ জন, নারী ভোটার ১৮ হাজার ৮৫৭। ভোটকেন্দ্র ১৪টি।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের অবস্থান:
ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘পাহাড়ের নির্বাচনগুলোতে পার্টির অবস্থান থাকে। এবারও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে পার্টি। আমরা বিভিন্ন উপজেলায় জেএসএসের সমর্থিত প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমরা জেএসএসকে সমর্থন দিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মতার্দশিক বিরোধ আগের মতো রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বা বৃহত্তর ঐক্যের স¦ার্থে পার্টি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। যাতে করে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতসহ অন্যান্য সমস্যাবলির সমাধান আসে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জুপিটার চাকমা জানালেন, ‘বাঘাইছড়ি উপজেলায় আমাদের দলের সমর্থিত প্রার্থী সুদর্শন চাকমা। লংগদুতে আমাদের দলের সমর্থন দেওয়া হয়েছে বাবুল দাশ বাবুকে (উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক)। তবে নানিয়ারচর পার্টির উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রূপম দেওয়ান ভোট করলেও তাকে আমাদের দলের সমর্থন দেওয়া হচ্ছে না। তবে সেখানেই আমরা দলের সমর্থন দেব। কৌশলগত কারণে আপাতত জানাচ্ছি না।’
তবে ভোটের মাঠে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান জানতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দলটির মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, ‘তৃতীয় ধাপের ভোটে রাঙামাটির কোনো উপজেলায় আমাদের কোনো প্রার্থী নেই। তবে বাঘাইছড়িতে জেএসএস - এনএম লারমার নেতা সুদর্শন চাকমাকে আমরা দলীয় সমর্থন দিয়েছি। অন্য দুটি উপজেলা নানিয়ারচর ও লংগদুতে সাধারণ জনগণ যাকে বেচে নেবেন, তার বেশি জনপ্রিয়তা রয়েছে; কৌশলগত বিষয় বিবেচনা করেই আমরা সমর্থন জানাব।
সমর্থন ‘আছে’ আবার ‘নেই’:
প্রথম ধাপে রাঙামাটি সদর, বরকল, জুরাছড়ি ও কাউখালী উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ধাপের ভোটে রাঙামাটি সদর, জুরাছড়ি ও বরকলে প্রার্থী দিয়েছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস। রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি, কুতুকছড়ি ও বন্দুকভাঙা ইউনিয়নে; বিশেষত সদর উপজেলার মধ্যে এই তিনটি ইউনিয়ন ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। প্রথম ধাপের ভোটে এই তিনটি ইউনিয়নে জেএসএসের সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিল ইউপিডিএফ। প্রথম ধাপের ভোটে রাঙামাটি সদর ও বরকলে জেএসএস সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে জুরাছড়ি ও কাউখালীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
দ্বিতীয় ধাপের ভোটে কেবল বিলাইছড়িতে বীরোত্তম তঞ্চঙ্গ্যাকে (দোয়াত কলম) চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে দলের সমর্থন দিয়েছে জেএসএস। এই উপজেলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যা প্রার্থী হয়েছেন আনারস প্রতীকে। বাকি দুই উপজেলা কাপ্তাই ও রাজস্থলীতে দৃশ্যত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের কোনো প্রার্থী নেই। তবে রাজস্থলীতে চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীকে লড়ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উবাচ মারমা এবং দোয়াত কলম প্রতীকে লড়ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন রানা।
কাপ্তাই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়েছেন তিনজন। এরমধ্যে আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী (বেবী) আনারস প্রতীক, মো. নাছির উদ্দিন দোয়াত কলম প্রতীক এবং সুব্রত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা ঘোড়া প্রতীকে লড়ছেন। তারা তিনজনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরমধ্যে আনোয়ারুল বেবী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, নাছির উদ্দিন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সুব্রত বিকাশ উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নেত্রী বলেছেন যার যত জনপ্রিয়তা আছে তা যাচাই করে দেখতে। যেখানে আমাদের দলের সমর্থনে একক কোনো প্রার্থী নেই। সেখানে তালাদা করে কাউকে সমর্থন দেওয়ার তো কথা আসে না। যে যার মতো করে ভোট করছেন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন।’
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একক সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি খারিজ করে দিলেও দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরুর আগে জেলা আওয়ামী লীগ রাঙামাটির দশ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা প্রসঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিক হয় দলীয় কার্যালয়ে। ওই বৈঠক থেকে কাউখালী, রাজস্থলী, বরকলে, বিলাইছড়ি, জুরাছড়িসহ অন্যান্য উপজেলায় একজন করে প্রার্থী হতে জোর তাগিদ দেয় দলটির জেলা কমিটির শীর্ষ নেতারা। যদিও শেষাবদি রাঙামাটি সদর, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী, লংগদুতে দলটির সাবেক-বর্তমান দায়িত্বে থাকা একাধিক ব্যক্তি প্রার্থী হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন, ‘আমাদের এ ধরণের কোনো বৈঠক হয়নি। যে যার মতো করেই প্রার্থী হচ্ছেন।’
স্মৃতিতে বিভীষিকা দিন:
২০১৯ সালের ১৮ মার্চ (সোমবার) পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালেট পেপার, সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে নির্বাচনি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ভোটগ্রহণ কাজে নিয়োজিতসহ মোট আটজনের মৃত্যু হয়।
এ হামলার ঘটনায় পাহাড়ের তিনটি আঞ্চলিক দলটি তখন একে-অপরকে ঘটনার জন্য দোষারোপ করছে। এবারের ভোটেও বাঘাইছড়ি উপজেলায় পাহাড়ের বিবাদমান চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল দ্বি-পাক্ষিক অবস্থান নিয়েছে। এরমধ্যে জেএসএস-ইউপিডিএফ একটি পক্ষ এবং জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আরেকটি পক্ষে রয়েছে। দৃশ্যত দুই গ্রুপে চারদলে বিভক্ত পাহাড়ের আঞ্চলিক দলসমূহ।
এবারের উপজেলা পরিষদ তথা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বাঘাইছড়িসহ অন্যান্য উপজেলায় ভোট ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নে দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র শাখার মধ্যকার পাল্টাপাল্টি গুলি বর্ষণের খবরও পাওয়া গেছে। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে; আরও আতঙ্ক বাড়ছে পাহাড়ে।
নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে রাঙামাটির চারটি উপজেলায় অত্যন্ত নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটেও যেন এমন পরিবেশ বজায় থাকে সেজন্য আমরা বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছি। নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা আশা করছি এবারের ভোটে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সজাগ-সচেতন রয়েছে কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যাতে বিঘিœত না হয়। গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’