শুক্রবার | ২৯ মার্চ, ২০২৪
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জুমচাষে

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঢালু পাহাড়ে আবাদ বাড়লেও উৎপাদন কমছে

প্রকাশঃ ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩ ১১:০২:০১ | আপডেটঃ ২৭ মার্চ, ২০২৪ ০২:৩০:৩২  |  ৭৮৮
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানÑ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় আউশ ফলন হিসেবে হাইব্রিড, উফশী (উচ্চফলনশীল জাত) ও জুমের ধান আবাদ হয়ে থাকে। তবে হাইব্রিড ও উফশীজাত মূলত সমতল জমিতে আবাদ হলেও জুম আবাদ হয়ে থাকে ঢালু পাহাড়েই। তবে গোটা আউশ মৌসুমের আবাদি শস্যের সিংহভাগ উৎপাদনই আসে প্রধানত জুমের ধান থেকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিন পার্বত্য জেলায় তুলনামূলকভাবে জুম আবাদের জমি বাড়লেও ফসল উৎপাদন কমেছে। কৃষিবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলো জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাবে মৌসুমের শুরুতে খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে ফসল উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। যার ফলে আবাদের পরিমাণ বাড়লেও উৎপাদন কমে আসছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ঢালু পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-গাছালি কেটে আগুনে পুড়ে তৈরিকৃত জমি বা পাহাড়ে চাষাবাদ করার পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়। জুমচাষ এক ধরণের স্থানান্তরিত কৃষি পদ্ধতি; অনেকেই জুম চাষকে ‘ঝুম চাষ’ও বলে থাকেন। জুম চাষ সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদ প্রথা। তবে এটি বর্তমানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তায় যোগান দিয়ে আসছে। প্রতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পাহাড়ের ঢালু স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। এরপর মার্চ-এপ্রিলের দিকে পাহাড়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অবশিষ্ট আগাছা ধ্বংস করা হয়। এপ্রিল-মে মাসে ঢালু পাহাড়ে সুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে ধানসহ নানান সবজির বীজবপন করা হয়। যে কারণে জুমচাষকে বহুফসলি চাষাবাদও বলা হয়ে থাকে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জুমের ফলন ঘরে তুলে জুমিয়া পরিবারগুলো। তবে দেরিতে আবাদের কারণে অনেকে অক্টোবরেও জুমের ধান তোলেন। জুমে স্থানীয় জাত হিসাবেÑ গেলং, কবরক, পাত্তিকী, সোনালী চিকন, বিন্নি, বাশধান, মেরী ধান, সাদা চড়ুই ধান, কনক চাপা, রেঙ্গই প্রভূতি লাগানো হয়। এসব ধানের মূল বৈশিষ্ট্য সুগন্ধি এবং আঠালো। তবে জুমে ধানের পাশাপাশি ‘সাথী সফল’ হিসাবে ভুট্টা, শসা, মরিচ, বেগুন, শিম, তিল, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙে, করলা, পাহাড়ি আলু, সাবারাঙ (একধরণের সুগন্ধিযুক্ত পাতা), কচু, হলুদ প্রভূতি ফসল লাগানো হয়। অন্যদিকে, জুম ক্ষেতে আগুন দেওয়ায় কারণে পাহাড়ের গাছপালা ও কীটপতঙ্গ পুড়ে যাওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্য বিপদাপন্ন হয়ে পড়ায় পরিবেশবাদীদের জুমে চাষ পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি থাকলেও স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্যনিরাপত্তা ও বিকল্প খাদ্য যোগানোর সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় এই চাষাবাদ পদ্ধতি এখনো গুরুত্ববহ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ মৌসুমে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলায় ১৭ হাজার ৭৮০ হেক্টর পাহাড়ে জুম আবাদ হয়েছে, যা থেকে ২৭ হাজার ৯৫৫ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে। পরবর্তীতে ২০২১-২২ মৌসুমে ১৬ হাজার ১৬৮ হেক্টর পাহাড়ে জুম আবাদ হলেও উৎপাদন হয়েছে ২২ হাজার ৭২৫ মেট্রিকটন। সবশেষ ২০২২-২৩ মৌসুমে ১৭ হাজার ৪২২ হেক্টর পাহাড়ে আবাদের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২২ হাজার ৫২৪ মেট্রিকটন। তিন বছরের উৎপাদন ও আবাদের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, ২০২০-২১ মৌসুম থেকে ২০২১-২২ মৌসুমে আবাদ ও উৎপাদন দুটোই কমেছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে বিগত মৌসুমের চেয়ে ১ হাজার ২৫৪ হেক্টরে আবাদ বাড়লেও উৎপাদন কমেছে আরো ১৯৯ টন। বিগত তিন খরিপ মৌসুমে আবাদি জুম পাহাড়ের সংখ্যা কমতি-বাড়তি হলেও উৎপাদন ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী।

অন্যদিকে জুমসহ তিন জেলার আউশের মোট ফলন উৎপাদনের হিসাবে দেখা গিয়েছে, ২০২০-২১ মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলায় ২৪ হাজার ৪৫৩ হেক্টর সমতল জমি ও পাহাড়ে আউশ আবাদের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৫৫ মেট্রিকটন। ২০২১-২২ মৌসুমে ২২ হাজার ৮০৮ হেক্টরে আবাদের বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছে ৪৪ হাজার ১০ মেট্রিকটন। সবশেষ চলতি মৌসুমে ২৪ হাজার ৪১৯ হেক্টরে আবাদের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪৩ হাজার ২৮১ মেট্রিকটন। ডিএই’র হিসাবেই তিন পার্বত্য জেলাতে ক্রমান্বয়ে আউশ মৌসুমে ধান উৎপাদন কমে এসেছে। আউশ মৌসুমে হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধানে উৎপাদন না কমলেও মূলত জুমের ধানে উৎপাদন কমেছে দুই বছরের মাথায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের খাদ্যশস্যের যোগান হয়ে থাকে আউশ ও বোরো ধান থেকে। ঘাটতি নিরাপত্তার বড় যোগান আসে আউশের মৌসুমের জুমের ধান থেকেই। তবে পরিবেশ ও জলাবায়ু পরিবর্তনগত কারণে জুমের ফলন উৎপাদন নিম্নমুখী।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়ে থাকে বান্দরবান জেলায়। বান্দরবানের থানচি, রোয়াংছড়ি ও রুমা উল্লেখজনকভাবে জুমচাষ হয়। জুমে চাষের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাঙামাটি; কমবেশি রাঙ্গামাটির প্রায় সব উপজেলায় আবাদ হলেও বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল ও জুরাছড়ি উল্লেখজনক। সবচেয়ে জুম আবাদ কম হয়ে থাকে খাগড়াছড়িতে। জুমক্ষেতে সাধারণত স্থানীয়জাতগুলোর ধান আবাদ করা হয়। যারমধ্যে বিন্নি, কবরক, গেলং, পাত্তিকী, বাশধান (সুগন্ধি) ও মেরী ধানজাত অন্যতম। জুমের এসব ধানের চাল আঠালো, কালো-লাল রঙের ও অন্যান্য বৈশিষ্টের হয়ে থাকে। তবে জুমে ধানের উৎপাদন বাড়াতে উফশী জাতের ধান হিসাবে বারিধান ৪৮ ও ৮৩ এবং বীণাধান ১৯ আবাদের পরিকল্পনা রয়েছে কৃষিবিদদের। এদিকে, চলতি বছর বান্দরবানের থানচি, রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলা এবং রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি সাজেক ও বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নে জুমক্ষেতে জুমে ইঁদুরের উপদ্রবে ফসল অনেকটা নষ্টা গিয়েছে। যে কারণে জুমের ধান উৎপাদন কিছুটা প্রভাব পড়লেও মহামারীভাবে প্রভাব পড়েনি বলছেন কৃষিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) বান্দরবানের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু এলাকায় জুমের ফসলে বুনো ইঁদুর হানা দিলেও সার্বিক ফলন উৎপাদনে প্রভাব ফেলেনি। ইঁদুরের উপদ্রবের খবর পেয়ে আমি বেশকিছু জুমক্ষেত পরিদর্শন করেছি। ফলন খুব একটা নষ্ট হয়নি, স্বাভাবিকভাবেই জুমের ফলনে ইঁদুরের উপস্থিতি থেকে থাকে। মূলত বিগত কয়েকবছরে এপ্রিল-মে মাসে জুম লাগানোর পর অনাবৃষ্টির কারণে জুমের ফলন ভালো হচ্ছে না। চলতি বছরও জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত অন্যান্য বছরের থেকে এক-তৃতীয়াংশ বৃষ্টিপাতও হয়নি। অনাবৃষ্টিতে খরায় জুমের ফলন উৎপাদনে ভাটা পড়ছে। তবে  খুব একটা শেষের দিকে বৃষ্টিপাত হলেও অনেকাংশে ফসল খেলেও পড়েও ফলন নষ্ট যায়। যে কারণে এবার ফলন উৎপাদন কমলেও ফসলের গুনগত মান ভালো হয়েছে। আউশের মৌসুমে সমতলের জেলাগুলোর চেয়ে পাহাড়ের আবাদ পদ্ধতি ভিন্ন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে আউশের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনগত সমস্যা কিংবা খরা-অনাবৃষ্টির কারণে জুমে ধান উৎপাদন কমে আসছে।’

ডিএই রাঙামাটি কার্যালয়ের উপপরিচালক কৃষিবিদ তপন কুমার পাল জানান, ‘চলতি বছর রাঙ্গামাটির বড়থলি ও সাজেকে জুমক্ষেতে বুনো ইঁদুরের উপদ্রবে ফলন কিছুটা নষ্ট হয়েছে। এরমধ্যে সাজেক ও বড়থলি মিলে ১ হাজারের অধিক ক্ষতিগ্রস্ত জুমচাষীর তালিকা করেছি। তন্মধ্যে কোন জুমিয়া কতটুকু কিংবা কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটিও নিরুপণ করে জেলা প্রশাসনে জমা দিয়েছি। এছাড়া বোরো মৌসুমে জুমে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা অনুযায়ী বাড়তি প্রণোদনার পরিকল্পনা রয়েছে কৃষি বিভাগের।’ কৃষিবিদ তপন কুমার পাল বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষের খাদ্যশস্য হিসাবে চালের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে আউশ ও বোরো আবাদ থেকে। তবে আউশ মৌসুমের জুম আবাদ থেকেও উৎপাদনের একটি বড় সহায়তা মিলে। চলতি বছরে জুম লাগানোর শুরুতে অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদন কমে আসছে।’

অর্থনীতি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions