বৃহস্পতিবার | ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদ্যুতায়ন প্রকল্প নিয়ে নয় ছয়ের অভিযোগ

প্রকাশঃ ০৩ অগাস্ট, ২০১৮ ১২:৪১:৪৩ | আপডেটঃ ২৩ এপ্রিল, ২০২৪ ১০:৫৫:৫১  |  ১১০৯
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্পে বিভিন্ন কাজের নামে আত্মসাৎ করা হচ্ছে বিপুল অর্থ। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে কাজ। শুধু মালামাল পরিবহণ নিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। অনুসন্ধানে এবারও বেরিয়ে এসেছে এসব অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য। এর আগেও তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। নামে কাজ করায় অকেজো হয়ে পরিত্যক্ত রয়েছে বেশকিছু প্রকল্প। ফলে এসব কাজে গচ্চা গেছে সরকারের কোটি কোটি টাকা।
এর আগে রাঙামাটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের নামে চলছে হরিলুট। ফলে বিদ্যুতের আওতায় আসতে পারছে না সংশ্লিষ্ট এলাকা। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের অর্ধশত বছর পর রাঙামাটি জেলার দুর্গম উপজেলা জুরাছড়িতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন হলেও আজও বিদ্যুৎ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত এলাকাবাসী। ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে কাপ্তাই থেকে বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এলাকার জনগণ আজও পুরোপুরি বিদ্যুতের আওতায় আসতে পারেনি। পায়নি বিদ্যুৎ সুবিধা। এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালনের নামে অপচয় করা হয়েছে সরকারের আরও কোটি কোটি টাকা। এতে ক্ষোভ বিরাজ করছে জনমনে।
জানা গেছে, এর আগে ৪০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পে জেলার তিনটি উপজেলা বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল বিদ্যুতের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে বিলাইছড়ি উপজেলা সরাসরি গ্রিড লাইনের আওতায় আসে। এতে ব্যয় হয় ২০ কোটি টাকা। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সবচেয়ে নিকটবর্তী উপজেলা বিলাইছড়িতে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য গ্রীড লাইন স্থাপন করা হয়েছে ২০০৫-০৬ অর্থ বছর। পরে বিলাইছড়ি থেকে গ্রীড লাইন সম্প্রসারণ করা হয় সরাসরি জুরাছড়িতে। বিলাইছড়ি থেকে জুরাছড়ি উপজেলা সদর পর্যন্ত ওই বৈদ্যুতিক গ্রীড লাইনের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার।

সংশি¬ষ্ট সূত্র জানায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায় সরাসরি গ্রিড লাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের লক্ষে ৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদ্যুতায়ন প্রকল্প এ গ্রীড লাইন স্থাপনার কাজ বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিগত জোট সরকারের আমলে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরাসরি গ্রিড লাইন স্থাপন করে বিলাইছড়ি উপজেলা বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়। পরে বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে জুরাছড়ি এবং বরকল উপজেলায় গ্রিড লাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করার জন্য আরও ২০ কোটি টাকার প্রকল্প শুরু হয়।

সূত্রটির মতে, এর আগে ১৯৮৯-৯০ সালে বিলাইছড়ি উপজেলায় জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। এতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৮ কোটি টাকা। তখন রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলা ছাড়াও তার নিকটবর্তী জুরাছড়ি, বরকল এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলায় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্প গৃহীত হয়। এ চারটি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পে সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বিগত জোট সরকারের আমলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায় আরও ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সোলারের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্প গৃহীত হয়। এছাড়া ২০০৫-০৬ সালে বরকল উপজেলা সদরে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় মাইক্রো হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্প। কিন্তু এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প কোন কাজেই আসেনি।


জানা যায়, বর্তমানে তিনটি পার্বত্য জেলাকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে গ্রহণ করা হয়েছে ৫৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। প্রকল্পটি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ‘তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে গত ২০১৭ সালের প্রথম দিকে। তিন বছর মেয়াদে নেয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। এরই মধ্যে প্রায় দেড় বছর পার হয়ে গেলেও প্রকল্পের অগ্রগতি কম বলে জানা যায়। অথচ প্রকল্পে বিভিন্ন নামে কাজ দেখিয়ে হরিলুট চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারদের যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা।
অন্যদিকে প্রকল্পের পরিচালক মতিউর রহমান প্রকল্প এলাকায় থাকার কথা থাকলেও তিনি ঢাকায় থাকেন বলে জানা গেছে। যোগাযোগের জন্য তার মুঠোফোন  নম্বরে বেশ কয়েক বার কল দেয়া হলেও রিসিভ করেননি তিনি। এ ব্যাপারে ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ উজ্জ্বল কান্তি বড়–য়া বলেন, এখন তো ডিজিটাল যুগ। এ যুগে কর্মস্থলে না থাকলেও চলে। তা ছাড়া প্রকল্প পরিচালকের এখানে কাজ নেই। তার কাজ ঢাকায়।

প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলে এ নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, কাজ চলছে। প্রকল্পের মূল কাজ হল বিদ্যুৎ বিতরণে লাইন টানা, সাব স্টেশন তৈরি। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে ২৫ কেভিএ, ৫০ কেভিএ, ১০০ কেভিএ, ২৫০ কেভিএ লাইন টানার কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। ৫৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর।
চট্টগ্রামে মালামাল মজুদ রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, নিরপদ জায়গায় রাখার নির্দেশ আছে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে মালামাল রাখা হয়েছে। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে অস্বীকার করে তিনি বলেন, ইজিপি’এর মাধ্যমে টেন্ডার আহবান হয়। এখানে কোনো রকম অনিয়ম দুর্নীতির সুযোগ নেই।     




সূত্র মতে, প্রকল্পে শুরু থেকে এ পর্যন্ত কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়ে গেছে। শুধু মালামাল পরিবহণে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি টাকার অধিক। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পরিবহণ ঠিকাদারদের দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আনা হয়েছে প্রায় ৮০০ ট্রাক মালামাল। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে কেভি লাইন সংযোগ তার, খুঁটিসহ বিভিন্ন উপকরণাদি ও সরঞ্জাম। সিডিউলের শর্ত অনুযায়ী এসব মালামাল সরাসরি পৌঁছানোর কথা রাঙ্গামাটি স্টোরে। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে সেগুলো মজুদ করা হয়েছে চট্টগ্রামের ফৌজদার হাটের কেন্দ্রীয় গুদামে। অথচ ভাউচার মেলানো হয়েছে সিডিউল মোতাবেক রাঙ্গামাটি পর্যন্ত পরিবহণ হিসাব করে। এতে প্রতি ট্রাকে পরিবহণ ব্যয় বাঁচানো হয়েছে ১২ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ৮০০ ট্রাকে বেঁচেছে ৯৬ লাখ টাকা। এসব টাকা গেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পকেটে। এসব মালামাল পরিবহন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এসবিএস কেবল্¬ বিআরবি কেবল্¬ এমএস কনফিডেন্স স্টিল, ইরা ট্রেডিং স্টিল, টিডি ট্রেডিং, চিটাগং স্টিল, বাশার অ্যান্ড ব্রাদার্স, মাইক্রো টেক, নাভানা উল্লেখযোগ্য। তবে এসব পরিবহন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কনফিডেন্স স্টিল’ এর কর্মকর্তা মো. মোর্তজা রহমান মালামাল রাঙামাটি পৌঁছানো হয়েছে বলে দাবি করেন। অথচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ উজ্জ্বল কান্তি বড়–য়া চট্টগ্রামে মজুদ করার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে মালগুলো মজুদ করা হয়েছে।


এছাড়াও প্রকল্পে স্থাপনা নির্মাণ, নতুন কেভি লাইন সংযোগ, যানবাহন ও অন্যান্য মালামাল, উপকরণ ক্রয়, মজুরিসহ বিভিন্ন নামে নানাভাবে অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বিপুল টাকা। এসব কাজের মধ্যে প্রকল্পের অধীনে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীতে ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি গোডাউন। এছাড়া ২টি পিকআপ, ১টি জীপ ও ৫টি মোটর সাইকেল ক্রয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের এতটুকু কাজেই পাওয়া গেছে এসব ব্যাপক হরিলুট ও নানা ঘাপলার অভিযোগ।

এদিকে চট্টগ্রাম থেকে নতুন করে পার্বত্য জেলায় অতিরিক্ত মালামাল পরিবহন ব্যয়ে লোকসানের ভয়ে বিভিন্ন কাজের টেন্ডার আহবান করা হলেও অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন ঠিকাদার অনেকে।

এমএম ইঞ্জনিয়ার্স নামে প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার মো. আবছার ও রাঙামাটির ঠিকাদার দানবীর চাকমা বলেন, মালামাল রাখা হয়েছে চট্টগ্রামে। কাজ নিলে সেখান থেকে আবার কাজের স্থলে মালামাল পরিবহনে দ্বিগুন ব্যয় হবে। এতে খরচ বেশী পড়বে। তাই লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। প্রকাশ্য টেন্ডার আহবান করা হলেও নানা অজুহাতে অন্য ঠিকাদারদের দরপত্র বাতিল করে অগ্রিম টাকা নিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য টেন্ডারে অংশ নিতে গেলে নানা হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে। কাজ দিতে নেয়া হচ্ছে ১০-১৫ ভাগ অগ্রিম পার্সেন্টেজের টাকা।

রাঙামাটি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions