সাজেকে অবহেলা আর কুসংস্কারে ২মাসে গেল ৬ প্রাণ !

প্রকাশঃ ২৩ মার্চ, ২০২০ ১২:৩৪:০৩ | আপডেটঃ ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০৭:২৩:৪৭
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। সাজেকে ২ মাসে ( ফেব্রুয়ারি মার্চ)  মাসে ছড়িয়ে পড়া ‘হাম’ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় দুটি মেডিকেল টিমের ‘কাজ’ করার মধ্যেই রোববার রাতে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম গেরেথি ত্রিপুরা(৯)। এনিয়ে সেখানে সাত থেকে বারো বছর ৬ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্ত হয়েছে আরও শতাধিক শিশু। এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের ‘অবহেলা’কে দায়ি করছেন স্থানীয়রা আর আক্রান্তদের ‘কুসংস্কার’কে দায়ি করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

তবে ‘আক্রান্ত এলাকায় কাল (২৪ মার্চ) সকালে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে একটি ‘বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম’ পাঠানো হচ্ছে’ বলে সন্ধ্যায় নিশ্চিত করেছেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ।

গত দুই সপ্তাহে উপজেলার পর্যটন জোন খ্যাত ‘সাজেক’ ইউনিয়নের দুর্গম তিনটি গ্রামে এ প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। আক্রান্ত এলাকার বাসিন্দার অভিযোগ করেছেন ‘এমবিবিএস চিকিৎসক ছাড়াই সরকারি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। সেখানে সহকারিরাই চিকিৎসা দিচ্ছেন। ফলে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না’।

শুক্রবার (২০ মার্চ) থেকে আক্রান্ত এলাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিজিবির দুটি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বাঘাইছড়ির ইউএনও আহসান হাবিব জিতু। আরও এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল (সোমবার) বাঘাইছড়ি গিয়ে জরুরি সভা করেছেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডাঃ বিপাশ খীসা।

সাজেক ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হিরানন্দ ত্রিপুরা বলেন, তার ওয়ার্ডের ‘অরুন পাড়া’, ‘লাংকাটান পাড়া’ ও ‘হাইচ্যাপাড়া’ এই তিনটি গ্রামে সর্বমোট ১০৮ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আছে। এরমধ্যে প্রাপ্ত বয়স্করাও আছেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও রোগটি শনাক্ত না হওয়ায় স্থানীয়রা বুঝতে পারেন নি। তাই সঠিক চিকিৎসার অভাবে পর পর এই ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন মুঠোফোনে জানান, ‘আক্রান্ত এলাকা উপজেলা সদর থেকে ৬/৭ ঘন্টার পায়ে হাটার পথ। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান হাবিব জিতু বলেন, ‘মেডিকেল টিমের কাজের মধ্যেই আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে কথা বলেছি’। কাল মেডিকেল টীম ঘটনাস্থলে যাবে।

নমুন রিপোর্ট আসার আগেই ৬ শিশুর মৃত্যু: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে গত হাম এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নমুন সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠিয়েছে। কিন্তু তার রিপোর্ট এখনও আসেনি। ফলে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে প্রাণহানীর সংখ্যা দীর্ঘ হয়েছে। তবে মৃত্যুর কারণ ‘হাম’ কিনা তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন সিভিল সার্জন। বলেন, ‘আমরা নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরীতে পাঠিয়েছি। রিপোর্ট আসার পরই কারণ জানা যাবে’।

এমবিবিএস ছাড়াই সরকারি মেডিকেল টীম: ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় বাসিন্দা ভুবন ত্রিপুরা অভিযোগ করেন ‘কাগজে কলমে দুইজন এমবিবিএস ডাক্তারের নেতৃত্বে মেডিকেল টীম থাকার কথা বলা হলেও তারা কেউ নেই। আছেন সহকারিরা। তারাই চিকিৎসা দিচ্ছেন। রাঙামাটির জেলা প্রশাসক বিষয়টি স্বিকার করে বলেন, ‘প্যারামেডিক যেতে পারলে এমবিবিএস ডাক্তার কেন আক্রান্ত এলাকায় যেতে পারবেনা? এটা দায়িত্বে অবহেলা’।

দায়ি ‘অবহেলা’ আর ‘কুসংস্কার’: স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, মূলত ‘দূর্গমতা’র অযুহাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারিরা আক্রাত এসব অঞ্চলে যান না। ফলে শতভাগ শিশুকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়ে উঠেনা। কেবল গড়ে ৪০ ভাগ শিশু টিকার আওতায় আসে। এছাড়া অনেক শিশুই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। ফলে তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। তাই দ্রুত শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য প্রাপ্ত বয়স্করাও আক্রান্ত হওয়া থেকে বাদ যান না। বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগও স্বীকার করেছে।

রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডাঃ বিপাশ খীসার দাবি ‘কুঃসংস্কারের প্রভাবে সেখানকার বাসিন্দারা আধুনিক চিকিৎসা নিতে সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না; ফলে প্রাণহানী ঘটেছে’।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ ইফতেখার আহম্মদ বলেন, ‘ওই এলাকার ৭টি গ্রামে হাম ও অন্যান্য রোগে আরও শতাধিক শিশু আক্রান্ত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এলাকার লোকজন অসচেতন বিধায় তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা সদরে আনা সম্ভব হচ্ছে না’।

স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, ওই এলাকায় ২০১৪ সালেও ‘ডায়রিয়া ও কলেরা’ ছড়িয়ে পড়ায় এই ধরণের সংকট তৈরি হয়েছিল। তবে সেসময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে জরুরি মেডিকেল টিম পাঠিয়ে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হয়েছিল। ফলে মহামারি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions