পার্বত্য চট্টগ্রামে সাঁওতালদের নেই ভূমি অধিকার ও নাগরিক সুযোগ সুবিধা

প্রকাশঃ ০৯ অগাস্ট, ২০১৯ ০৬:৫৮:৪৭ | আপডেটঃ ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ১০:৫৯:১২
সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার তিনটি পল্লীতে ১২৯ পরিবার সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে। নিজ দেশে পরবাসীর মতো বেড়ে উঠছে সাঁওতালদের আগামী প্রজন্ম। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দূরে থাক নেই মৌলিক অধিকারও। ১৯৬০ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়ে খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও লক্ষ্মীছড়িতে এসে ঠাঁই নেই শতাধিক সাঁওতাল পরিবার। তবে পূর্ব পুরুষেরা ভূমির মালিকানার কোন কাগজপত্র সংগ্রহ না করায় যুগ যুগ ধরে সরকারি খাস ভূমিতে বসবাস করতে হচ্ছে। নিজস্ব ভূমি না থাকায় অন্যের জমিতে কৃষি কাজ ও শ্রমিকের কাজ করে জীবন নির্বাহ করছে বর্তমান প্রজন্ম। আগামী প্রজন্মও বেড়ে উঠছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যেৎ।
সরেজমিনে পানছড়ির বড় সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ৩৯ পরিবারের একটি গ্রামে নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক কিলোমিটার দূরের প্রদীপ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে পার হতে হয় খরা¯্রােতা চেঙ্গী নদী। বর্ষাকলে ২-৩ মাস বিদ্যালয়ে যেতে পারে না শিক্ষার্থীরা। এতে করে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। কষ্ট করে যে কয়েকজন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাশ করেছে তাদের অধিকাংশ বেকার। সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ী তিন জেলার উন্নয়নে পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করে। পাহাড়ে বসবাসরত প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বে চলছে এসব পরিষদ। তবে এখন পর্যন্ত খাগড়াছড়িতে সাঁওতালদের কোন প্রতিনিধি পৌঁছাতে পারেনি। পরিষদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও কোটায় সাঁওতালদের কোন অংশগ্রহণ নেয়। এতে করে পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠী ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি দীর্ঘ দুই দশকে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে সাঁওতালদের নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ও দাতা সংস্থারা কাজ করলেও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত খাগড়াছড়ির সাওঁতালরা।

ময়নামতি সাঁওতাল বলেন, ৪ জনের সংসারে অভাব নিত্য সঙ্গী। বর্গাতে নেয়া জমিতে কৃষি কাজে শ্রমিক নিতে না পারায় পরিবারের ৩ সদস্য কাজ করি। তবে যে ফলন আসে তা দিয়ে জমির মালিককে দেয়ার পর খাওয়ার মতো আর কিছু জুটে না।  

বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাগরিকা সাঁওতাল বলেন, প্রতিদিন ১০-১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানছড়ি সদরের স্কুলে ও কলেজে গিয়ে পড়ালেখা করেছি। কখনও গাড়ী ভাড়া না থাকলে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়েছে। অথচ, এতো কষ্ট করে পড়ালেখা শিখে কোন উপকারে আসেনি। বিভিন্ন সরকারি চাকরীতে আবেদন করে পরীক্ষা দেয়। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় চাকরী হয় না। এখন যে চাকরী করি তা থেকে ঠিক মতো বেতন পায় না।

পানছড়ি সাঁওতাল কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মিলন সাঁওতাল বলেন, সাওঁতালরা ভূমি ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। খাস ভূমিতে যুগের পর যুগ বসবাস করে আসলেও সরকার বন্দোবস্ত দিচ্ছে না। অথচ, প্রভাবশালীরা টাকা দিয়ে বন্দোবস্ত কিংবা কাগজ বানিয়ে ভূমির মালিক হচ্ছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় সাঁওতালদের পূর্বপুরুষের শ্মশান দখল করে নিয়েছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী চক্র। দিন মজুরীর সংসারে যে কয়েকটি পরিবার ছেলেমেয়েদের কষ্ট করে পড়ালেখা শিখিয়েছে তাদের কপালে জুটছে না চাকরী। সরকারি চাকরীতে ঘুষ বাণিজ্য ও স্থানীয় ভাবে জেলা পরিষদের নিয়োগে সাঁওতালদের কোন কোটা রক্ষা না হওয়ায় হতাশ হচ্ছে তরুণ সমাজ। ব্রিটিশ আমল থেকে সাঁওতালদের গৌরবোজ্জল ইতিহাস থাকলেও কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে যাচ্ছে। কাপ্তাই বাঁধ আমাদের পূর্ব পুরুষের সকল ইতিহাস মুছে দিয়েছে। আর বর্তমান সময়ে সরকার আমাদের জাতিসত্ত্বার ঐতিহ্য মুছে দিচ্ছে।



খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, তার মেয়াদে ২০১৭ সালে চাঁদনী সাঁওতাল নামে একজন যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরী পেয়েছে। এছাড়া অনেকেই জেলা পরিষদ ও অধীনস্থ দপ্তরে খন্ডকালীন ভাবে কাজ করছে। এছাড়া সাঁওতালদের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায় সে লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে তা সংরক্ষণে কাজ চলছে।

ছবি’র ক্যাপশন: খাগড়াছড়ির আদিবাসী নারীদের সংগ্রামী জীবন। পুরুষের পাশাপাশি সংসার ও জীবিকার তাগিদে আদিবাসী নারীরা কাজ করে ঘরে বাইরে।

সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions