মঙ্গলবার | ১৯ মার্চ, ২০২৪

সচেতনতার অভাব ও কুসংস্কারের কারণে সাজেকে নিয়ন্ত্রণে আসছে না হাম, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ও জনবল নিয়োগ জরুরী

প্রকাশঃ ০৭ এপ্রিল, ২০২০ ০৪:০৯:৫২ | আপডেটঃ ১৮ মার্চ, ২০২৪ ০৮:১৪:০৪  |  ১৯৯৫
হিমেল চাকমা,  সাজেক থেকে ফিরে।  পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ৭নম্বর পাড়া থেকে সাজেক সড়কের পাশে একটি দোকানে দুই সন্তানকে ডাক্তার দেখাতে আনেন পতিমালা ত্রিপুরা (৪০)। সাথে আরো ৩ টি শিশু। বড় শিশুটির বয়স ৫ বছর। ২য়, ৩য় শিশু হামে আক্রান্ত।

পতিমালা বলেন, ওদের প্রথমে জ্বর হয়। এরপর পুরোর শরীরে গুটি দেখা দেয়। চোখ মুখ ফুলে, লাল হয়, কোনায় ময়লা জমে। শাসকষ্ট বাড়ে। জ্বর থাকে। কোন কিছু খেতে চায় না।

ডাক্তাররা একে হাম বলছেন। চাকমারা বলে লুদি। মারমারা বলে ওয়োসাহ্। ত্রিপুরারা বলে লুতিসাহ্।

অসুস্থ শিশুদের গরম পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেন না পতিমালা। ঔষধ হিসেবে পুজি পাতার ( সুগন্ধি পাতা যা জুমে চাষ হয়) পানি খেতে দেন। আর বনের লতাপাতা সিদ্ধ করা পানি দিয়ে গোসল করান।

একই গ্রামের  ধনেন্দ্রলাল ত্রিপুরা (৪০)’র দুই শিশুও হামে আক্রান্ত। তিনিও একইভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তাঁর শিশুদের শুকর ঘুয়ের (বিষ্ঠা) পানিও খেতে দিয়েছেন বলেন ধনেন্দ্রলাল। তবুও ভাল হচ্ছে না।  

শিবপাড়া গ্রামের গোপতি ত্রিপুরা (৪৫) বলেন, অসুস্থ শিশুকে তেল, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়ানো হলে গুটি আরো বাড়ে। এ ভয়ে শুধুমাত্র গরম পানি পান করতে দিচ্ছেন।  এটা গ্রামের সবাই করে।  টিকা নিলে শিশুদের জ্বর হয়। কান্না করে। তাছাড়া এ টিকা নিলেও কি উপকার হয় তাও আমার জানা নেই।  

এ কথাগুলো শুধু পতিমালা, ধনেন্দ্রলাল,  গোপতি ত্রিপুরার নয়। কথাগুলো  সাজেকের দুর্গম শিবছড়া, ৭ নম্বর, শিয়ালদহ,অরুন পাড়া, তুইচুই, লুংথিয়ান পাড়া, উদলছড়ি, ভুয়াছড়ি, কজতলি, বেতবুনিয়া, হাচ্চাপাড়া,শিলছড়ি গ্রামের মানুষের মুখের কথা।

সেসব গ্রামে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম পায়ে হাটা কোথাও নৌকা। মাচালং বাজার থেকে এসব গ্রামের এক একটির দুরত্ব কোথাও ২০ কোথাও ৭০ কিলোমিটার। মাচালং বাজার থেকে গন্তব্যে পৌছতে সময় লাগে এক থেকে দুই দিন।

স্থানীয় সরকারী ও এনজিও স্বাস্থ্য কর্মীদের তথ্যমতে এসব গ্রামে বর্তমানে ২ শতাধিক শিশু হাম রোগে আক্রান্ত।
এ রোগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারী থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত মারা গেছে মোট ৯ জন। এ রোগ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে একের পর এক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।

সাজেক  ইউপি চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে দেখা দেওয়া এ হাম নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে একের পর এক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।

চলমান মেডিকেল সেবা পর্যাপ্ত নয়:
জেলা স্বাস্থ্য বলছে সাজেকের হাম নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে একাধিক মেডিকেল দল। তবে সরেজমিনে এর সত্যতা মিলেনি।  স্বাস্থ্য কর্মীরা পালাবদল করে এলাকায় গিয়ে একটি দলে কাজ করছেন।  এ দলে কাগজে কলমে এমবিবিএস ডাক্তার রাখা হলেও  প্যারামেডিক বা স্বাস্থ্য সহকারীকে এমবিবিএসের ভুমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
গেল ৩০ মার্চ বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডা. বিষ্ণু পদ দেবনাথের নেতৃত্বে  একটি মেডিকেল দল ৭ নম্বর পাড়ায় যান। সেখানে  মোট ৩১ জন রোগীর মধ্যে ১৮জন শিশু। এরমধ্যে ৪ জন শিশুকে হাম বলে সনাক্ত করেন বিষ্ণু পদ। এ চারজনকে হামের ঔষধ দিলেও বাকীদের জ্বরের ঔষধ দেন।

সেদিনই রোগী দেখে ৭ নম্বর পাড়া ত্যাগ করে সরাসরি বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফিরে যায় মেডিকেল দল। কিন্তু সেদিন রাতে ৭ নম্বর পাড়ায় আরো দুজনের শরীরে গুটি ভেসে উঠে।

ডা. বিষ্ণু পদ দেবনাথ বলেন, এখানের চিত্রটা ভিন্ন। অসুস্থ রোগীকে ভাল ও পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়ার বিপরীতে  খাবার দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখানে কুসংস্কারে ভরপুর। অবিভাবকরা সচেতন নয়। এখানে দীর্ঘ মেয়াদী কাজ করতে হবে।

সচেতনতা আর পরিচ্ছন্নতায় পিছিয়ে ত্রিপুরারা:  
সাজেকে চাকমা ত্রিপুরা পাশাপাশি গ্রামে বসবাস করে। চাকমাদের তুলনায় অপরিচ্ছন্ন দেখা গেছে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর ও আঙিনা। এরা যেমন অপরিচ্ছন্ন তেমনি অসচেতনও।
৭ নম্বর ত্রিপুরা পাড়ার পাশে ৯ নম্বর চাকমা পাড়া।  ৯ নম্বরে একজনও হামে আক্রান্ত না হলেও ৭ নম্বরে আক্রান্ত হয় ১২ জন।
৯ নম্বর গ্রামের শান্তি চাকমা (৫৫) বলেন, আমাদের গ্রামে হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা গেছে আরো ৩০ বছর আগে। টিকা কর্মীরা সড়কের পাশে নির্দিষ্ট দোকানে বা স্কুলে বসে শিশুদের টিকা দেয়। এ সময় চাকমা শিশুদের টিকা নিতে দেখা গেলেও ত্রিপুরারা আসে না।




স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যাপ্ত নয়:
১৭৭১.৫৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সাজেক ইউনিয়নে জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। রয়েছে মাত্র ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক।  একটি এনজিও কাজ করলেও প্রকল্প শেষ হওয়ায় চলতি মাসে বন্ধ হওয়ার কথা এনজিওটির কার্যক্রম। কমিউনিটি ক্লিনিকে কোন ডাক্তার নেই।  ক্লিনিকে ১জন ফার্মেসিস্ট, ১জন পিয়ন আছে।

পুষ্টিহীনতা ভুগছে শিশুরা
বর্তমানে পাহাড়ে সব গাছের পাতা ঝড়ে পড়েছে। শুকিয়ে গেছে পানির উৎসগুলো। ময়লা পানি পান ও ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয়রা। তারা বলেন খাদ্য সংকট দেখা দেয় তীব্রভাবে। বনে খাওয়ার মত কোন কিছু পাওয়া যায় না।

গুজব আর কুসংস্কারে বিশ্বাস:

সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা বলেন, ডাক্তারী  চিকিৎসার পর নাকি ৮ জন শিশু মারা গেছে। এ  গুজব ছড়ানো হয়। ফলে অনেকে চিকিৎসা নিতে আসছে না। চিকিৎসা নিতে জোর করতে হচ্ছে আমাদের।
কুসংস্কারের কারণে হাম রোগ থেকে বাঁচতে নানা পুজা করে যাচ্ছে তারা। এ গুজব রটানোর কারণে অবিভাবকরা তাদের ছেলেদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনীর হেলিতে পর্যন্ত তুলতে দিচ্ছে না।


টিকা পায় না সাজেকের শিশুরা:
সরকারী বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচির আওতায় টিকা পায় না সাজেকের শিশুরা। প্রাদুর্ভাব প্রবণ এলাকায় রয়েছে টিকা নেওয়ার ভীতি। এছাড়ায় এলাকায় যখন টিকা পৌছায় তখন টিকা বহনকরা আইস বক্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। আইস বক্সের মেয়াদ থাকে ২৪ ঘন্টা। কিন্তু সাজেকে এমন এলাকা আছে যেখানে ৪৮ ঘন্টায়ও টিকা পৌছানো সম্ভব নয়।
সাজেকের ৯ নম্বর পাড়া গ্রামের গ্রামপ্রধান চিরঞ্জীব ত্রিপুরা (৫০) বলেন, শিশুরা টিকা পায় না।  টিকা কার্ড না থাকার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করে দিচ্ছে না।

সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সবুজ চক্রবর্তী বলেন,  যাদের টিকা কার্ড নেই তাদের তাদের জন্ম নিবন্ধন করছি না। আমরা শিশুদের টিকা নিতে অবিভাবকদের চাপ দিচ্ছি।

একাধিক ক্লিনিক দরকার:
সাজেকের অর্ধেক এলাকা জুড়ে রয়েছে সংরক্ষিত বন। এর মাঝে রয়েছে বিশাল জনবসতি। বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যায় কাচালং নদীর এপাড় ওপাড়ে রয়েছে চেল্লাতলি, বেতবুনিয়া, উজানছড়ি, লাম্বাবাগ, হজতলি, শিলছড়ি, ভুয়াছড়ি গ্রাম। এছাড়া শিয়ালদহ, তুইচুই মৌজায় আলাদা ক্লিনিক দরকার।



ডাক্তারদের পরামর্শ:
সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শহীদ তালুকদার বলেন, হাম প্রাদুর্ভাব এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানকার লোকজনকে সচেতন করা জরুরী। এজন্য ত্রিপুরা কমিউনিটিও উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের ধর্মীয় পুরহিতরাও এ কাজ করতে পারে।  না হলে এ অপচিকিৎসার প্রতি ঝুঁকে থাকবে তারা। ডাক্তাররা ঔষধ দিলেও তারা যদি এ ঔষধ সেবন না করে তবে রোগ ভাল হবে না সেটা বুঝাতে হবে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক কর্মকর্তা ডা. নুয়েন খীসা বলেন, শুধু সাজেক নয় পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সমস্যা। পাহাড়ের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত জনবল নিয়োগ দেওয়া জরুরী। সাজেক ইউনিয়নকে সমতলের এক ইউনিয়ন ভাবার কোন সুযোগ নেই। এ ইউনিয়নটি দেশের কোন কোন উপজেলার চেয়েও বড়।  সেখানে মানুষদের হাসপাতালমুখী করতে সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ক্লিনিকের নামে জমি রেজিস্ট্রেশন করতে বন বিভাগের আইন শিথিল করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বন বিভাগের জায়গায় কোন কিছু করা যাবে না এ নীতিতে থাকলে  ভবিষ্যতে এ চিত্র আরো ভয়াবহ হবে।




বর্তমান সিভিল সার্জন যা বলেছেন:
জেলা সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা বলেন, সাজেকে হাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। একটি গ্রামের পর আরেকটিতে দেখা দিচ্ছে। এ কার্যক্রম আজ কাল শেষ হবে না।  আগামী ৯ মাস নিয়মিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১১ হাজার শিশুকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।
এজন্য আরো জনবলের প্রয়োজন। সাজেকে টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে হলে সে এলাকায় একাধিক পয়েন্ট সোলারে চলে এমন ফ্রিজ রেখে সেখানে টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন সাজেক বিশাল কর্ম এলাকা। বর্তমানে সেখানে যে জনবল আছে তা দিয়ে এত বড় প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখানে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে আমাদের। সেখানে সর্বনি¤œ ৫টি ক্লিনিক দরকার। প্রতিটি ক্লিনিকে ৫ জন করে স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ দেওয়া দরকার। পাশাপাশি এসব স্বাস্থ্য কর্মীদের সহায়তা করতে আইস বক্স বহনের জন্য প্রত্যক স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য একজন করে লোক দরকার। এদের জন্য আলাদা বরাদ্ধ দরকার।

রাঙামাটি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions