শনিবার | ২০ এপ্রিল, ২০২৪

বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডে সুদর্শনের এজেন্টদের টার্গেট করেছিল সন্ত্রাসীরা !

প্রকাশঃ ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০৫:৪২:১৫ | আপডেটঃ ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ০৩:২৮:২৭  |  ২২৭৭
সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডটি মুলত নির্বাচন কেন্দ্রিক বলে ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনে সকালে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের পর সরাদিন শান্তিপুর্ন ভোট গ্রহণ হলেও ফলাফল নিয়ে ফেরার পথে  মূল টার্গেট ছিল চেয়ারম্যান প্রার্থী সুদর্শন চাকমার পোলিং এজেন্টদের হত্যা করা। বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনকারী এজেন্টদের বহনকারী গাড়িতে টার্গেট করে ব্রাশ করেছিল সন্ত্রাসীরা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট কেন্দ্রের নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা উপজেলা সদরে ফেরার পথে দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি সড়কের সাড়ে এগারো মাইল  এলাকায় সন্ত্রাসীরা গাড়ী বহরে ব্রাশ ফায়ার করে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুদর্শন চাকমার নির্বাচনী পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার ভুইয়াছড়ির প্রভাত চন্দ্র চাকমার ছেলে স্ট্রং চাকমা ও  খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুংয়ের তপতি চাকমার ছেলে মন্টু চাকমা। নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ শেষে বাঘাইহাট থেকে কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইটি গাড়ীসহ বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের গাড়ি বিজিবি পাহারায় বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে বাঘাইহাট কেন্দ্রের গাড়ি পরিবর্তন করে স্ট্রং চাকমা ও মন্টু চাকমা বহরের তৃতীয় গাড়ি যেটি কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সেটিতে উঠে। বিজিবি’র টহল দলের পেছনে বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গাড়ি বহর ছিল। বিকেল সাড়ে ৬টার কিছু সময় পর বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের সাড়ে এগার কিলোমিটারের বটতলা এলাকায় পৌঁছানোর পর ওৎপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা বিজিবির গাড়ির অতিক্রমের পর পেছনের গাড়ীগুলোতে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। বাঘাইহাট কেন্দ্রের গাড়িতে ফায়ার টার্গেট মিস হলেও ওই গাড়িতে মো: মাহবুব আলম নামে এক শিক্ষক ও মো: ইউসুফ মিয়া নামে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়। কংলাক কেন্দ্রের গাড়িতে থাকা পোলিং এজেন্টদের গাড়িতে রাস্তার দুইপাশ থেকে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। নিহত ৭ জনই কংলাক কেন্দ্রের গাড়িতে ছিল। মাচালং কেন্দ্রের গাড়িতেও ব্রাশ ফায়ার করে সন্ত্রাসীরা। কিন্তু কোন গাড়ি না দাড়িয়ে দ্রুত চলে যাওয়ায় আরও হতাহতের হাত থেকে রক্ষা পায় চার গাড়িতে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্যরা।

ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠিত দুই তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি দলের ঘটনাস্থল ও সংশ্লিষ্টদের সাথে সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ও শুক্রবার (২২ মার্চ)। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি সড়কের সাড়ে এগার কিলোমিটারের বটতলা এলাকায় বামপাশের চায়ের দোকানের পাশে ঝাড়–ফুলের স্তুপের আড়াল থেকে সন্ত্রাসীরা ব্রাশফায়ার করে। রাস্তার দুই পাশ থেকে আনুমানিক চল্লিশ সেকেন্ড ব্রাশফায়ার করা হয়। সবগুলো গাড়ি না দাড়িয়ে দ্রুত চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের বিজিবির প্রশিক্ষণটিলা ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পরে সেখান থেকে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে উপজেলা হাসপাতালে যায়। পরে সেখান থেকে হতাহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় নেয়া হয়। হামলার ঘটনায় ৪ আনসার ভিডিপি সদস্যসহ ৭ জন নিহত হয় এবং ২৯ জন আহত হয়। আহতরা ঢাকা ও চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। কেন্দ্রে নির্বাচন সরঞ্জাম ও সংশ্লিষ্টদের পরিবহনকারী গাড়িতে পোলিং এজেন্টদের উঠার বিষয়টি কেউ জানতো না বলে জানিয়েছেন। নির্বাচন অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, নির্বাচনী সরঞ্জাম ও জনবল বহনকারী গাড়িতে কোন প্রার্থীর লোকজনকে রাখার কোন চর্চা নেই। ঘটনার দিন তারা কিভাবে গাড়িতে এসেছে সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।




হামলার পেছনে পোলিং এজেন্টদের টার্গেট করা হয়েছিল কিনা এবিষয়ে জানতে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতি এমএন লারমা গ্রুপের কেন্দ্রীয় ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক সুদর্শন চাকমার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, স্ট্রং চাকমা পোলিং এজেন্ট হিসেবে বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছে। তবে মন্টু চাকমা পোলিং এজেন্ট ছিল না। পোলিং এজেন্টরা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। তারা শুধুমাত্র এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে। ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত দাবি করে বড় ঋষি চাকমা নির্বাচনে জিততে পারবে না জেনে ক্ষোভ থেকে জনসংহতি সমিতি সন্তু গ্রুপ ও ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ হামলা চালিয়েছে।

তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে বড় ঋষি চাকমার মুঠোফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সন্তু গ্রুপের তথ্য ও প্রচার বিভাগ থেকে বিনয় কুমার ত্রিপুরার প্রেরিত এক ই-মেইল বার্তায় ঘটনার সাথে তাদের দায় অস্বীকার ও নিন্দা জানিয়ে একটি মহল কর্তৃক জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মনগড়া, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও প্রতিহিংসামূলকভাবে অভিযোগ করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানানো হয়।

ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সংগঠক মাইকেল চাকমা জানান, বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ কোন প্রার্থী দেয়নি এবং কাউকে সমর্থনও করেনি। ইউপিডিএফ’র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দোষ চাপানো হচ্ছে।




ঘটনার পরের দিন রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির অপরাধীরা চিহ্নিত দাবি করে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ না করার কথা বললেও ২০ মার্চ রাতে অজ্ঞাত আসামী করে মামলা দায়ের করে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকলেও এখনও কাউকে আটক করা যায়নি। ২২ মার্চ সকালে যৌথবাহিনীর অভিযানে ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরের ঝোঁপঝাঁড় থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ঘটনার দিন নিহত আনসারের পিসি মিহির কান্তি দত্তের কাছ থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। তবে ঘটনার দিন অস্ত্রটি কি ভাবে খোয়া গিয়েছিল সেটির বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারেনি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের গঠন করা ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান দীপক চক্রবর্তী জানান, হামলার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। তদন্ত কমিটি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলছে। ঘটনার কারণ, কারা দায়ী এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন পুন:রায় না ঘটে সে লক্ষ্যে সুপারিশ করবে কমিটি।   

শুক্রবার(২২ মার্চ) বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে খাগড়াছড়িতে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর। তিনি বলেন, হামলার ঘটনাটি নির্বাচনী সহিংসতা। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো আধিপত্য বিস্তারের জেরে হামলাটি করেছে। পাহাড়ে সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও আধুনিকায়ন করতে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হবে বলেও জানান তিনি।

গত ১৮ মার্চ বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শেষে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হয় ৭ জন এবং আহত হয় ২৯ জন।

খাগড়াছড়ি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions